– আবদুল্লাহ আল মাসউদ
মক্কা শহরের নাম শুনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই শহরের অপর একটি নাম আছে, যেটা অনেকের কাছেই অপরিচিত। সেটি হলো বাক্কা। পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে মক্কা শহরকে তার পরিচিত নামে উল্লেখ না করে বাক্কা নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ কী? সেই রহস্য আমরা জানব। তবে তার আগে বাক্কা শব্দের অর্থ সম্পর্কে জেনে নেই।
বাক্কা শব্দের দুইটি অর্থ আছে। এক- ভীড় হওয়া, দুই- কর্তন করা বা উপড়ে ফেলা। মক্কা শহরে এই দুইটি বিষয়ই পাওয়া যায়।
প্রথম বিষয়টি এভাবে পাওয়া যায় যে, পুরো পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে মানুষজন মক্কায় এসে ভীড় জমায়। আল্লাহর ঘর কাবা তাওয়াফ করে। দিন নেই রাত নেই, সবসময় এখানে মানুষের ভীড় লেগে থাকে এখানে। আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে মক্কা যিয়ারতের তাওফিক দান করেছেন তারা বিষয়টি ভাল করেই জানেন। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের এক জায়গায় বলেছেন,
وَ اِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَ اَمۡنًا
এবং যখন আমি কাবাগৃহকে বানালাম মানবজাতির সমাবেশস্থল ও নিরাপত্তাস্থল। (বাকারা : ১২৫)
আর দ্বিতীয় বিষয়টি কীভাবে পাওয়া যায় সেটা মোটামুটি সবারই জানা আছে। তা হলো, মক্কা শহরকে যে ধ্বংস করতে চায়, আল্লাহ কুদরতিভাবে তাকে ধ্বংস করেন। তার লেজ কেটে দেন এবং শিকড় উপড়ে ফেলেন। কুখ্যাত আবরাহার ঘটনায় আমরা এমনটাই দেখেছি। তাকে সদলবলে এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যে, আজ তার নাম ছাড়া আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। না তার বংশ, না তার রাজত্ব।
এবার আসি, কুরআনে কেন সকলের কাছে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ শব্দ মক্কার পরিবর্তে একটি আয়াতে বাক্কা নামটি ব্যবহার করা হলো সেই রহস্যের কাছে।
আমরা একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, যেই আয়াতে মক্কাকে বাক্কা নামে উল্লেখ করা হলো সেই আয়াতটি ছিল হজ্ব প্রসঙ্গে। আর এটা তো জানা কথাই যে, হজ্বের সময়েই মক্কা থাকে লোকে লোকারণ্য। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে আগমন করা মানুষের পদভারে মুখরিত। ফলে হজ্বের সাথে সম্পর্কিত আয়াতের সাথে বাক্কা নামটিই ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। যে আয়াতে বাক্কা শব্দের মাধ্যমে মক্কার পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা হলো-
اِنَّ اَوَّلَ بَیۡتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیۡ بِبَکَّۃَ مُبٰرَکًا وَّ هُدًی لِّلۡعٰلَمِیۡنَ فِیۡهِ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ مَّقَامُ اِبۡرٰهِیۡمَ ۚ وَ مَنۡ دَخَلَهٗ کَانَ اٰمِنًا ؕ وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ
‘নিশ্চয় প্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তা মক্কায়। যা বরকতময় ও হিদায়াত বিশ্ববাসীর জন্য। তাতে রয়েছে স্পষ্ট নির্দশনসমূহ, মাকামে ইবরাহীম। আর যে তাতে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ হয়ে যাবে এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।’ (সূরা আলে ইমরান ৯৬-৯৭)
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হলো, আয়াতের শুরুতে মানুষের জন্য প্রথম স্থাপিত ঘরের কথা বলা হয়েছে, যাকে আমরা কাবা নামে চিনি। কাবা যখন প্রথম স্থাপিত হয়, সেই সময় মক্কা ছিল ধু ধু মরু প্রান্তর। পাথুরে পাহাড় আর বালিয়াড়ি ছাড়া সবুজ-শ্যামলতার কোন ছোঁয়া সেখানে ছিল না। এই ঘটনার সাথে বাক্কা শব্দের ব্যবহার এদিকে ইঙ্গিত বহন করে যে, এই এলাকাতে যদিও এখন কোন মানুষজন নেই, চারপাশে সব বিরানভূমি; কিন্তু অচিরেই তা লোকে লোকারণ্য ও জনবসতিপূর্ণ হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গক্রমে পবিত্র কুরআনে এই শহরের উল্লেখ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
মক্কা নামটি কুরআনে শুধু একবার উল্লেখিত হয়েছে সূরা ফাতহে। আয়াতটি হলো-
وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُم بِبَطْنِ مَكَّةَ مِن بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا
‘মক্কা উপত্যকায় তিনিই তাদের হাত তোমাদের থেকে আর তোমাদের হাত তাদের থেকে বিরত রেখেছিলেন তোমাদেরকে তাদের উপর বিজয়ী করার পর। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন।’ (সূরা ফাতহ:২৪)
মক্কা শহরের অন্য আরেকটি নাম হলো উম্মুল কুরা। যার অর্থ হলো সকল শহরের মূল। যেহেতু এই শহরেই সর্বপ্রথম কোন ঘর স্থাপিত হয়েছে সেই হিসেবে একে সকল শহরের মূল ধরা হয়। কেননা একটা শহর গড়ে উঠে সেখানে মানুষজনের ঘরবাড়ি ও বসতি স্থাপন করার মাধ্যমে। যেই আয়াতে মক্কাকে উম্মুল কুরা নামে অভিহিত করা হয়েছে তা হলো,
وَ هٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ مُبٰرَکٌ مُّصَدِّقُ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَ لِتُنۡذِرَ اُمَّ الۡقُرٰی وَ مَنۡ حَوۡلَهَا ؕ
‘আর এই কিতাবও (কুরআন) আমিই অবতীর্ণ করেছি; যা খুবই বরকতময় কিতাব এবং পূর্বের সকল কিতাবকে সত্যায়িত করে থাকে, যেন তুমি উম্মুল কুরা তথা মাক্কা নগরী এবং এর আশপাশের জনপদের লোকদেরকে তার দ্বারা ভীতি প্রদর্শন করতে পারো।’ (সূরা আনআম:৯২)
সূরা ত্বীন এর ৩ নং আয়াতে মক্কাকে ‘আল-বালাদুল আমীন’ (وَهَذَا الْبَلَدِ الْأَمِينِ) বা নিরাপদ নগরী নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা এই নগরীকে তাঁর শত্রুদের হাত থেকে নিরাপদ রাখবেন। আবার যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ থাকবে। যেমনটা আমরা পেছনে সূরা আলে ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে দেখে এসেছি। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘আর যে তাতে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ হয়ে যাবে।’