পার্সোনাল-ব্লগের-পিক-1-1024x341

মুহাদ্দিসদের দর্পণে যঈফ হাদীস

উসুলে হাদীসে খ্যাতি পাওয়া আলেমদের অন্যতম হলেন আবু আমর ইবনুস সালাহ। এই বিষয়ে তার লেখা ‘মারিফাতু আনওয়ায়ি ইলমিল হাদীস’ প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য গ্রন্থগুলোর একটি। একে মুকাদ্দমা ইবনে সালাহও নামেও ডাকা হয়। উক্ত গ্রন্থে সহীহ হাদীসের আলোচনায় লেখক বলন,

‘যখন মুহাদ্দিসগণ বলেন, ‘এই হাদীসটি সহীহ’ তখন তার অর্থ হল, সহীহ হওয়ার সকল গুণাবলী এতে বিদ্যমান এবং এর সনদও অবিচ্ছিন্ন। তবে বাস্তবেও হাদীসটা অকাট্য (১০০% প্রমাণীত) হওয়া আবশ্যক নয়। কারণ, কতক সহীহ হাদীস এমন আছে, যা কেবল একজন ন্যায়পরায়ণ রাবী বর্ণনা করেন। এবং সেটি ওইসব হাদীসেরও অন্তর্ভুক্ত নয় যা গ্রহণ করার বিষয়ে পুরো উম্মত একমত। এমনিভাবে যখন তারা কোন হাদীসের বিষয়ে বলেন, ‘এটি সহীহ নয়’ তখন বাস্তবেও সেটা মিথ্যা হওয়া অকাট্য নয়। কারণ অনেক সময় এটি বাস্তবে সহীহ হয়ে থাকে। এই কথার দ্বারা তাদের শুধু এতোটুকু বুঝানো উদ্দেশ্য যে, সহীহ হাদীসের শর্তানুসারে এর সনদটা সঠিকভাবে প্রমাণীত হয়নি।’

আল্লামা নববী রহ.ও তার তাকরীব গ্রন্থে একই মত উপস্থাপন করেছেন। এই মতের ব্যাখ্যায় আল্লামা সুয়ুতী রাহ. তার তাদরীবুর রাবী গ্রন্থে বলেন, ‘বাস্তবেও অকাট্য না হওয়ার কারণ হল, শক্তিশালী রাবীও মাঝেমধ্যে ভুল করে থাকেন। আবার যে রাবী খুব বেশি ভুল করে সেও অনেক সময় সঠিকটাই বর্ণনা করে।’[1]

এবার বিষয়টা আমরা উদাহরণ দিয়ে বুঝি। তাহলে আরেকটু স্পষ্ট হবে। ধরুন, একজন রাবী একশটা হাদীস বর্ণনা করলে ষাট বা সত্তরটাতে ভুল করে। বাকিগুলো সঠিকভাবে বলে। তো তাকে আমরা দুর্বল রাবী হিসেবে চিহ্নিত করি। তার বর্ণিত সব হাদীসকেই দুর্বল বলে সাব্যস্ত করি। কিন্তু কথা হল, প্রতিটি হাদীসকে দুর্বল বললেও কিছু হাদীসের মধ্যে (অর্থাৎ সেই ত্রিশ বা চল্লিশটা হাদীসের মধ্যে) কিন্তু সঠিক হবার সম্ভাবনা বিদ্যমান। হ্যা, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে, সে হাদীসগুলো কোনটা কোনটা। সেজন্যই যখন তার হাদীসের সমর্থনে অন্যকোন সাহাবী বা তাবেয়ীর ফতোয়া কিংবা উম্মতের ধারাবাহিক আমল পাই তখন বুঝতে পারি যে, এই হাদীসটি তাঁর সেসব হাদীসের অন্তর্ভুক্ত যেগুলোতে তিনি ভুল করেননি। ফলে এটি গ্রহণ করে নিতে আর কোন সমস্যা থাকে না। কারণ, রাবী দুর্বল হবার কারণে এখানে যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল সেটা আর নাই। যদিও পরিভাষায় তাকে যঈফ বা দুর্বল হাদীসই বলা হবে। এমন হাদীসগুলোর ক্ষেত্রেই ইমাম তিরমিজি রাহ. তাঁর সুনানে তিরমিজীতে বলেন, ‘হাদীসটি যঈফ হলেও উম্মত একে গ্রহণ করে নিয়েছে বা উম্মতের আমল এর উপরই।’

এই বিষয়টা না বুঝার কারণে অনেক ভাই বিভ্রান্তিতে পতিত হন। তারা শুধু যঈফ শব্দটা দেখেই বেঁকে বসেন। খেয়াল করেন না বা করার চেষ্টা করেন না যে, বাস্তবেও কি সন্দেহটা বিদ্যমান আছে না তা দূর হয়ে গেছে।

কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে, সন্দেহ যেহেতু দূর হয়েছে তাহলে তাকে আর যঈফ বলা হচ্ছে কেন? সহীহ বললেই তো হত। আসলে মূল বিষয় হল, সহীহ বলার জন্য মুহাদ্দিসরা একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন। সে সংজ্ঞা অনুপাতে না হলে তাকে সহীহ বলা হবে না। যদিও পরবর্তীতে ভিন্ন কারণে তার থেকে সন্দেহ দূর হয়ে যায়। যদি সহীহ-যঈফের সংজ্ঞা এমন হত−সন্দেহ দূর হলে সহীহ আর না হলে যঈফ, তাহলে সন্দেহ দূর হয়ে যাওয়া এমনসব হাদীসকেও সহীহ বলা হত। কিন্তু বিষয়টি সেরকম নয়।

অবশ্য খুব মারাত্মক পর্যায়ের যঈফ হলে এবং যঈফ হাদীস গ্রহণ করার অন্যান্য যে শর্ত আছে তা না পাওয়া গেলে সেটা অবশ্যই বর্জন করতে হবে।

অনেকে যঈফ হাদীসকে শতভাগ অগ্রহণীয় মনে করে থাকে। এটি সঠিক নয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষ এবং শর্ত সাপেক্ষে যঈফ হাদীস গ্রহণীয় হতে পারে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে এমন কিছু ক্ষেত্রের কথা তুলে ধরছি।

ক. কোন বিষয়ে যদি যঈফ হাদীস ব্যতীত অন্য কোন দলীল পাওয়া না যায়

শরীয়তের মাসআলার দলীলের বিভিন্ন অবস্থা হতে পারে। অনেক সময় একটি মাসআলায় কুরআন-হাদীসের একাধিক দলীল বিদ্যমান থাকে। অনেক সময় শুধু একটি দলীল থাকে। যদি কখনও এমন হয় যে, কোন বিষয়ে যঈফ হাদীস ছাড়া আর কোন দলীল নেই, তখন তা বিবেচনাযোগ্য হতে পারে। ইমাম নাসাঈ রাহ. এর নীতি ছিল প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির হাদীস আনা, যাকে বর্জন করার ব্যপারে মুহাদ্দিসীনে কেরাম একমত হননি। ইবনে মানদাহ রাহ. বলেন, ইমাম আবূ দাউদও তাঁর অনুরূপ পন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি দুর্বল সনদের হাদীস (তার সুনানে) নিয়ে আসেন, যখন তিনি কোন অধ্যায়ে যঈফ সনদ ব্যতীত অন্য কোন হাদীস না পান। কেননা তার নিকট যঈফ সনদ মানুষের কিয়াস থেকে উত্তম। আর এটা ইমাম আহমাদ রাহ. এরও মত। তিনি বলেছেন, যঈফ হাদীস আমার নিকট মানুষের কিয়াসের চেয়ে অধিক পছন্দনীয়।[2]

অবশ্য এক্ষেত্রে যঈফ হাদীসটি ইজমা বিরোধী না হওয়া শর্ত। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রাহ. লিখেছেন, ‘ইমাম আহমাদ রাহ. যদি কোন বিষয়ে আসার না পান, কোন সাহাবীর বক্তব্য না পান; বরং এমন যঈফ হাদীস পান, যার বিপরীতে উম্মতের ইজমা বর্ণিত হয়নি, তখন তার নিকট কিয়াস করার চেয়ে উক্ত যঈফ হাদীসের উপর আমল করাই অধিক উত্তম । ইমামদের মধ্য হতে এমন কেউ-ই নেই, যিনি এই মূলনীতিতে একমত নন। তাদের প্রত্যকেই যঈফ হাদীসকে কিয়াসের উপর প্রাধান্য দিতেন। যেমন ইমাম আবু হানীফা রাহ. নামাযে উচ্চস্বরে হাসলে উযূ ভেঙ্গে যাওয়ার হাদীসকে কিয়াসের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। অথচ সমস্ত মুহাদ্দিসীন হাদীসটি যঈফ হওয়ার ব্যাপারে একমত।[3]

খ. যখন কোন যঈফ হাদীসকে সমগ্র উম্মত সাদরে গ্রহণ করে  

হাদীসের ভাণ্ডারে এমন বহু হাদীস আছে, যার সনদ যঈফ হলেও সমগ্র উম্মত যুগ যুগ ধরে তা গ্রহণ করে আসছে।[4] এই জাতীয় হাদীসের ক্ষেত্রে সনদগত দুর্বলতা তা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী রাহ. এর বিশিষ্ট সাগরেদ ও বিখ্যাত মুহহাদ্দিস ও উসুলে হাদীসবিদ আল্লামা সাখাবী রাহ. লিখেছেন, ‘উম্মত যখন কোন যঈফ হাদীসকে সাদরে গ্রহণ করে, তখন বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী তার উপর আমল করা হবে। এমনকি অনেক সময় তা (ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে) মুতাওয়াতিরের[5] পর্যায়ে পৌছে যায়। ফলে তা অটাক্যভাবে প্রমাণীত কোন বিষয়কেও রহিত করে দেয়। এজন্যই ইমাম শাফেয়ী রাহ. ‘ওয়ারিসের জন্য কোন ওসিয়ত নেই’ এই হাদীসের ব্যপারে বলেছেন, মুহাদ্দিসীনে কেরাম উক্ত হাদীসটি সহীহ সনদে মেনে নেননি। তবে উম্মত তা সাদরে গ্রহণ করেছে এবং তার উপর আমল করে এসেছে। এমনকি কুরআনের ওসিয়তের আয়াতকে পর্যন্ত তা রহিত করে দিয়েছ।’[6]

এই বিষয়ে আল্লামা কাশ্মীরী রাহ. এর বক্তব্যটিও দেখা যেতে পারে। তিনি বলেছেন,  ‘ওয়ারিশের জন্য কোন ওসিয়ত নেই’ হাদীসটি সর্বসম্মতিক্রমে যঈফ। তবে তার হুকুম প্রমাণীত হওয়ার ব্যপারে সকলে একমত। উলামাদের একটি দল বলেছেন, কোন হাদীস যখন (উম্মতের) আমল দ্বারা শক্তিশালী হয় তখন তা দূর্বল অবস্থা থেকে কবূলের স্তরে পৌছে যায়। আর এটাই আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়।’[7]

৩. যদি হাদীসটি ফাযায়েল সংক্রান্ত হয়

আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস বর্জনীয় হলেও শর্তসাপেক্ষে আমলের ফযীলত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস গ্রহণীয় হবার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুহাদ্দিস ও উসুলে হাদীসবিদ আলেমগণ মত দিয়েছেন। এই বিষয়ে আল্লামা মোল্লা আলী কারী রাহ. লিখেছেন, ‘সমস্ত উলামায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, যঈফ হাদীস আমলের ফযীলতের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য।’[8]

যেই শর্তগুলোর ভিত্তিতে ফযীলতের ক্ষেত্রে যঈফ হাদীসকে গ্রহণ করার সুযোগ আছে তা ৩টি। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শরহু নুখবাতিল ফিকার’ এ তা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো, ক. অতিমাত্রায় যঈফ না হওয়া। খ. শরীয়তসিদ্ধ অন্য কোন আমলের অধীনস্ত হওয়া। অর্থাৎ, যে আমলের ফযীলত উল্লেখ থাকবে, সেই আমলটি অন্য শক্তিশালী দলীলের মাধ্যমে সাব্যস্ত হওয়া। গ. আমলের সময় এই বিশ্বাস না রাখা যে, এটি সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। কেননা এতে করে নবী সা. এর প্রতি এমন বিষয়কে সম্পৃক্ত করা হয়, যা তাঁর থেকে নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।

নাওফালী রহ. বলেন, আমি আহমাদ রহ. কে বলতে শুনেছি, ‘যখন আমরা হালাল, হারাম, সুন্নাত এবং আহকাম সম্পর্কে কোন হাদীস বর্ণনা করি তখন সনদের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখি। আর যখন ফাযায়েলে আমাল এবং আহকাম ছাড়া অন্য বিষয়ে হাদীস বর্ণনা করি তখন সনদের প্রতি নমনীয় থাকি।’[9]

হাফেজে হাদীস আবূ বকর আস সাখাভী রহ. বলেন, ‘ফাযায়েলে আমাল, তারগীব, তারহীব ও মানাকেব ইত্যাকার বিষয়ে যঈফ হাদীস অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে নমনীয় হওয়া চাই। আর আহকাম, হালাল-হারাম, আকায়েদ বা আল্লাহ তায়ালার সিফাত (গুণাবলী) ইত্যাদি বিষয়ক হাদীসের ক্ষেত্রে কঠোরতা করা উচিত। এটি আব্দুর রহমান বিন মাহদী রহ. সহ অধিকাংশ ইমামগণ হতে বর্ণিত। মাঝে রয়েছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহ., ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ., ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহ., ও ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনা রহ. প্রমুখ।’[10]

শর্তসাপেক্ষে আমলের ফযীলত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে যঈফ হাদীস গ্রহণীয় হবার পক্ষে যেসব মুহাদ্দিসদের মত ছিল তাদের মধ্য হতে ৪০ জনের নামের সংক্ষিপ্ত তলিকা তুলে ধরছি-

১. ইমাম সুফইয়ান সাওরী রহ. (মৃ. ১৬১ হি.)

২. ইমাম মালেক রহ. (. ১৭৯ হি.)

৩. ইমাম আবু দাউদ রহ. (মৃ. ২৭৫ হি.)

৪. ইমাম তিরমিযী রহ. (মৃ. ২৭৯ হি.)

৫. ইমাম নাসায়ী রহ. (মৃ. ৩০৩ হি.)

৬. আব্দুল্লাহ বিন মোবারক রহ. (মৃ. ১৮১ হি.)

৭. ইমাম ওয়াকী রহ. (মৃ. ১৯৭ হি.)

৮. ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না রহ. (মৃ. ১৯৮ হি.)

৯. ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদী (মৃ. ১৯৮ হি.)

১০. ইমাম শাফেয়ী রহ. (মৃ. ২০৪ হি.)

১১. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রহ. (মৃ. ২৩৪ হি.)

১২. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. (মৃ. ২৪১ হি.)

১৩. ইমাম বুখারী রহ. (মৃ. ২৫৬ হি.)

১৪. ইমাম আবু হানীফা রাহ. (১৫০ হি.)

১৫. ইমাম ইবনে মাজাহ রহ. (মৃ. ২৭৩ হি.)

১৬. ইমাম তহাবী রহ.(মৃ.৩২১ হি.)

১৭. হাকেম নিশাপুরী রহ. (মৃ. ৪০৫ হি.)

১৮. ইমাম বায়হাকী রহ. (মৃ. ৪৫৮ হি.)

১৯. ইবনে আবদুল বার. (মৃ. ৪৬৩হি.)

২০. আবু যাকারিয়া আম্বরী রহ. ২১. ইবনে কুদামা রহ. (মৃ. ৬২০ হি.)

২২. আবূল হাসান বিন কাত্তান রহ. (মৃ. ৬২৮ হি.) 

২৩. ইবনে সালাহ রহ. (মৃ. ৬৪৩ হি.)

২৪. ইবনে আব্দুস সালাম রহ. (মৃ.৬৬০ হি.)

২৫. ইমাম নববী রহ. (মৃ. ৬৭৬ হি.)

২৬. ইবনে দাকীকুল ঈদ রহ. (মৃ. ৭০২ হি.)

২৭. ইমাম যাহাবী রহ. (মৃ. ৭৪৮ হি.)

২৮. হাফেজ যাইলায়ী রহ. (মৃ. ৭৬২ হি.)

২৯. হাফেজ সালাউদ্দীন আ’লায়ী রহ. (মৃ.৭৬১ হি.)

৩০. হাফেজ ইরাকী রহ. (মৃ. ৮০৬)

৩১. সাইয়্যেদ শরীফ জুরজানী রহ. (মৃ.৮১৬ হি.)

৩২. আল্লামা ইবনে হুমাম রহ. (মৃ. ৮৬২ হি.)

৩৩. হাফেজ ইবনে হাজার রহ. (মৃ.৮৫২ হি.)

৩৪. হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী রহ. (মৃ. ৮৫৫ হি.)

৩৫. হাফেজ সাখাভী রহ. (মৃ. ৯০২ হি.)

৩৬. আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী রহ. (মৃ. ৯১১ হি.)

৩৭. জালালুদ্দীন দাওয়ানী রহ. (মৃ.৯১৮ হি.)

৩৮. হাফেজ ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী রহ. (মৃ.৯৭৪ হি.)

৩৯. মোল্লা আলী কারী রহ. (মৃ. ১০১৪ হি.)

৪০. হাফেজ আব্দুর রউফ মানাভী রহ. (মৃ. ১০৩১ হি.)

একটি সংশয় নিরসন

আজকাল কিছু লোক দাবি করা শুরু করেছে, যঈফ হাদীসের উপর কোনমতেই আমল করা যাবে না। এক্ষেত্রে তারা অল্প কয়জন[11] ইমামের নাম উল্লেখ করে থাকে এবং একেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুহাদ্দিসদের মত হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে। অথচ পেছনে আমরা এই বিষয়ে তালিকাসহ বাস্তবতা আবলোকন করে এসেছি।

এই তালিকাতে যাদের নাম উল্লেখ করা হয় এর মধ্যে ইমাম বুখারীর নাম অন্যতম। মূলত ইমাম বুখারী রাহ. তার সহীহ বুখারীতে কোন ধরনের যঈফ হাদীস উল্লেখ না করার কারণে অনেকে মনে করে থাকে, তার দৃষ্টিতে যঈফ হাদীস সর্বক্ষেত্রে অগ্রহণীয় ছিল। অথচ বাস্তবতা তেমন নয়। কেননা ইমাম বুখারীর অন্যান্য হাদীস গ্রন্থগুলোর দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই সেখানে প্রচুর পরিমাণ যঈফ হাদীস আছে। যেমন আল-আদাবুল মুফরাদ, জুযউ রাফইয়িল ইয়াদাইন, জুযউল কিরাআতি খালফাল ইমাম ইত্যাদি। যদি সর্বক্ষেত্রে যঈফ হাদীস বর্জন করা তার নীতি হতো, তাহলে তিনি সেই গ্রন্থগুলোতে যঈফ হাদীসকে স্থান দিতেন না। তার ব্যাপারে এমনটা মনে করা বোকামি হবে যে, এই হাদীসগুলো যঈফ হওয়া সম্পর্কে তিনি জানতেন না। কেননা যদি এমনি হতো, তাহলে তার পক্ষে সহীহ বুখারীর মত বিশুদ্ধতম হাদীস গ্রন্থ সংকলন করা সম্ভব ছিল না।

এই বিষয়ে শায়েখ আবূল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রহ. এর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘পূর্ববর্তী ইমামগণের মত ইমাম বুখারী রহ.ও স্বীয় কিতাব ‘আদাবুল মুফরাদ’ এ একই পন্থা (যঈফ হাদীস গ্রহণ করা) অবলম্বন করেছেন। সেহেতু তিনি ‘আদাবুল মুফরাদ’-এ অনেক যঈফ হাদীস ও আসার দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। এমনকি কোন কোন অধ্যায়ে তো শুধুমাত্র যঈফ হাদীস-ই উল্লেখ করেছেন। যার সনদের মধ্যে যঈফ, মাজহুল, মুনকার ও মাতরূক জাতীয় বর্ণনাকারী বিদ্যমান।’[12]

ইমাম মুসলিমের ব্যাপারেও এই ধরনের দাবি করা হয়। এই দাবি আংশিক সত্য হলেও সর্বাংশে সত্য নয়। মূল ব্যাপারটা বোঝার আগে ভূমিকা স্বরূপ আরেকটি বিষয় জেনে নেই। তা হলো,যঈফ হাদীস দুই ধরনের- এক. অত্যন্ত যঈফ। খ. সামান্য যঈফ।  ইমাম মুসলিম তার সহীহ মুসলিমের ভূমিকাতে যঈফ হাদীস গ্রহণ না করার বিষয়ে যে কঠিন মত ব্যক্ত করেছেন, গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে অনুভূত হয় তিনি এর মাধ্যমে অত্যন্ত যঈফ হাদীসকে বুঝিয়েছেন। কেননা যঈফ হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি যে সকল বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, তা অত্যন্ত যঈফ হাদিসেরই বৈশিষ্ট্য। যেমন বর্ণনাকারী মিথ্যা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া, প্রচুর পরিমাণে ভুল করা ইত্যাদি। তো এসব হাদীস বর্জনীয় হবার ব্যাপারে তো তাদেরও দ্বিমত নেই, যারা শুধু ফাযায়েলের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে যঈফ হাদীস মানার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন।  

লেখাটি শেষ করছি একটি কারচুপির কথা উল্লেখ করে। তা হলো, একদিন একটি আর্টিকেলে দেখতে পেলাম যঈফ হাদীস সর্বক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য হওয়ার মত ব্যক্ত করার পর দলিল হিসেবে ‘কাওয়াইদুত তাহদীস’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা হয়। আমি মূল গ্রন্থ থেকে যাচাই করে দেখলাম, লেখক সেখানে যঈফ হাদীসের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের তিনটি মত উল্লেখ করেছেন−এক. সর্বক্ষেত্রে এটি বর্জনীয়। এই মতের পক্ষে যাদের থাকার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তারা হলেন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইবনুল আরাবী মালেকী, ইবনু হাযম[13]। দুই. সর্বক্ষেত্রে এটি গ্রহণীয় হবে। 3. সর্বক্ষেত্রে গ্রহণীয় হবে না। বরং ফাযায়েলের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে গ্রহণীয় হবে। এই শেষোক্ত মতকে তিনি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আর্টিকেলের লেখক শুধু প্রথম মতটি উল্লেখ করে এই গ্রন্থকে সূত্র হিসেবে পেশ করার মাধ্যমে মনে হয়, ওই গ্রন্থের লেখকও এই মত পোষণ করেন। অথচ বাস্তবতা পুরোই উল্টো। এটি ইলমী বিচারে সম্পূর্ণ খিয়ানত। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমীন।


[1] তাদরীবুর রাবী : ৫৫ পৃষ্ঠা

[2] তাদরীবুর রাবী, আল্লামা সুয়ূতী : ৯৭

[3] ইলামুল মুওয়াক্কিয়ীন, ইবনুল কাইয়িম : ১/৩১

[4] উল্লেখ্য যে, এখানে উম্মত বলতে প্রাজ্ঞ আলেমগণ উদ্দেশ্য। এটাকে পরিভাষায় তালাক্কিল উম্মাতি বিল ক্ববুল বলা হয়। 

[5] মুতাওয়াতির হলো হাদীসের একটি প্রকারের নাম। যা শুদ্ধতার বিচারে সবচে উঁচুস্তরের।

[6] ফাতহুল মুগীস, সাখাবী : ১২০

[7] ফয়জুল বারী : ৩/৪০৯

[8] মিরকাত, মোল্লা আলী কারী : ৩/৩৪০ 

[9] খুলাসাহ : ১৬

[10] যাফারুল আমানী : ১৮৫, টীকা।

[11] যেমন ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইবনুল আরাবী মালেকী, ইবনু হাযম। এই কয়জনের বাইরে এত এত বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের মধ্যে আর তেমন কারো নাম উল্লেখ করতে পারে না। যাদের নাম উল্লেখ করে, তাদের মত নিয়েও কিছু কথ আছে। যা প্রবন্ধে সামনেই উল্লেখ করা হয়েছে। 

[12] যাফারুল আমানী : ১৮২, টীকা।

[13] তিনি লিখেছেন, ইবনে মাঈনের কথা উল্লেখ করেছেন উয়ুনুল আসার গ্রন্থের লেখক ইবনু সায়্যিদিন নাস, আর ইবনুল আরাবী মালেকীর কথা উল্লেখ করেছেন আল্লামা সাখাবী তাঁর ফাতহুল মুগিস গ্রন্থে। এই দুইজনের উদ্ধৃতি দেবার পর তিনি নিজের মত ব্যক্ত করেছেন এই বলে, ‘ইমাম বুখারীর সহীহুল বুখারীতে শুধু সহীহ হাদীস আনা ও ইমাম মুসলিমের সহীহ মুসলিমের ভূমিকার কথা পড়লে অনুমিত হয় যে, তাদের মতও এমনই হবে।’ কিন্তু তার এই অনুমান কেন সঠিক নয় তা আমরা উপরে আলোচনা করে এসেছি। 

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

জনপ্রিয় ব্লগ

কুরআন

আমার হিফজ-যাত্রা

শুরু করার আগে আল্লাহর দেওয়া তাওফীকে আলহামদুলিল্লাহ আমার হিফজের সবক শেষ হয়েছে। আল্লাহর অনেক শুকরিয়া আদায় করছি। পরিচিত অনেক আপুদের

পুরোটা পড়ুন