জেনারেল শিক্ষিত ভাই-বোনরা দ্বীনের পথে আসার পরে ইলম অর্জনের প্রতি সচেষ্ট হচ্ছেন এটি খুবই সুসংবাদের কথা। কিন্তু এই পথ মাড়াতে গিয়ে অনেকেই কূলকিনারা খু্ঁজে পান না। কোত্থেকে শুরু করবেন, কী দিয়ে শুরু করবেন, কোথায় পড়বেন, কার কাছে পড়বেন, কীভাবে পড়বেন এমন হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় করে তাদের মাথায়। এগুলোর সদুত্তরও সহজে খুঁজে পান না অনেকে। ফলে তাদের ইলমচর্চার পথটা হয় অনেক বেশি কণ্টকাকীর্ণ কিংবা অগোছালো ও অসম্পূর্ণতায় ভরা।
এই লেখাতে আমরা মোটামুটিভাবে ইলমচর্চার পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তবে সামগ্রিক একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। ব্যক্তিভেদে এতে কমবেশ হতে পারে বা ধরনে একটু-আধটু পরিবর্তন আসতে পারে। তবে মৌলিকভাবে পুরো বিষয় এমন বা এর কাছাকাছিই হবে আশা করি।
প্রত্যেক ব্যক্তির ইলমচর্চার সময়-সুযোগ সমান নয়। তাই প্রথমেই নিজের দিকে তাকাতে হবে। বুঝতে হবে, তিনি কোন ক্যাটাগরির। তার হাতে সময় কতটুকু আছে, সুযোগ কতটুকু আছে। সময়-সুযোগের আনুপাতিক হারে নিজের পুরো ইলমচর্চার পথটিকে সাজাতে হবে।
এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেককেই দেখা যায়, নিজের সময়-সুযোগের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে হুট করেই কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে বা কোন এক জায়গা থেকে শুরু করে দিচ্ছে। ফলে কুলোতে না পেরে এক পর্যায়ে ইলমচর্চা ছেড়ে দিচ্ছে এবং এই সুযোগে হতাশা তাকে পুরোপুরি মুড়িয়ে নিচ্ছে। শয়তান তার মানে এমন ভাবনার উদ্রেক ঢুকিয়ে দিচ্ছে তোমাকে দিয়ে ইলমচর্চা হবে না। অথচ সে যদি নিজের ক্যাপাসিটি বুঝে সেইভাবে যাত্রা শুরু করত তাহলে এমনটা হত না।
প্রথমেই খুঁজে দেখুন, অফলাইনে ভাল ও যোগ্য কোন আলিমের কাছ থেকে ইলমচর্চা করার সুযোগ আপনার আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে সময়মত তাঁর কাছে যান এবং নিজের ইচ্ছা ও প্রয়োজনের কথা তাকে খুঁলে বলুন। আশা করি তিনি আপনার প্রবল ইচ্ছাকে মূল্যায়ন করবেন। আর যদি সেই সুযোগ না থাকে তাহলে বর্তমানে বহু অনলাইন একাডেমি তৈরি হয়েছে ভাল মানের কোন একাডেমি খুঁজে সেখানে প্রয়োজনীয় কোর্সে ভর্তি হয়ে নিন। কীসে ভর্তি হবেন সেই বিষয়ে সামনে বিস্তারিত কথা আসবে।
মনে রাখবেন, অনলাইনের পড়াশোনা কখনোই অফলাইনের পড়াশোনার ঊর্ধে নয়। অফলাইনে পড়াই হলো ইলমচর্চার প্রধান ও প্রথম মাধ্যম। তাই সুযোগ থাকলে একেই আঁকড়ে ধরা উচিত। এতে করে সরাসরি পড়ার বরকত পাওয়া যায় এবং উস্তাযের সোহবত পাওয়া সম্ভব হয়, যার প্রভাব-প্রতিপত্তি অনস্বীকার্য। যদি এটি পারা না যায় তখন সেকেন্ড অপশন হিসেবে অনলাইনের ভালো কোন প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিন।
ইলমচর্চার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি কুরআন পড়তে না পারেন তাহলে সর্বপ্রথম শুদ্ধভাবে কুরআন পড়া শিখার পেছনে সময় দিন। তারপর অন্যদিকে মনোযোগ দিন। অনেকে ভাই-বোন আছেন, যারা শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারে না কিন্তু অন্যান্য বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন কোর্সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ফলে দিন যত গড়ায়, অন্যান্যা জিনিস তার শেখা হলেও কুরআনের তিলাওয়াত থেকে যায় আগের মতোই। এটি খুবই গর্হিত কাজ এবং কুরআনের প্রতি এক প্রকারের অবহেলা প্রদর্শন। এই ধরনের ত্রুটি কারো মধ্যে থাকলে তার উচিত দ্রুতই তা সংশোধন করে নেওয়া।
কুরআন শুদ্ধ করে পড়ার পর প্রথমেই কুরআনের অনুবাদ পড়ুন। সাথে খুব সংক্ষিপ্ত কোন তাফসীর। মূল মনোযোগ থাকবে কুরআনের অনুবাদের উপর। শুধু প্রাসঙ্গিক শানে নুযুল বা কোন জায়গার মর্মার্থ স্পষ্ট না হলে তখন সংক্ষিপ্ত তাফসীর থেকে সেটা স্পষ্ট হয়ে নিন। মনে রাখবেন, আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন, তাফসীর নয়। তাফসীরের মধ্যে অনেক কিছুই থাকে। তাই প্রথমবার আপনার মূল ফোকাস যেন থাকে আল্লাহর বক্তব্যের ওপর। পরবর্তীতে না হয় আল্লাহর বক্তব্যকে উপজীব্য করে কে কী বলল সেটা জানলেন। শুরুতেই বড় তাফসীর পড়তে যাবেন না। এটি আপনার তাফসীর-পাঠকে ব্যাহত করতে পারে। সেজন্য প্রথমেই বড় মাপের তাফসীর হাতে না তুলে সংক্ষিপ্ত তাফসীর পড়ুন।
পুরো কুরআনের অনুবাদ পড়া হলে কিছুটা বিস্তারিত তাফসীরের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারেন। এক্ষেত্রে তাফসীর নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সকল তাফসীর একই রকম ধারা অবলম্বন করে রচিত নয়। কোনটা একাডেমিক কথাবার্তায় ঠাঁসা, কোনটা সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তাদের জীবনঘনিষ্ট ভাবনার সাথে মিল রেখে সহজ-সরল ভাব ও ভাষায় রচনা করা। আপনার উচিত দ্বিতীয় শ্রেণীর তাফসীর গ্রন্থকে পাঠের জন্য নির্বাচন করা। এতে করে আপনার তাফসীরপাঠ অনেক প্রাণবন্ত ও উপকারী হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে মনোনিবেশ করা উচিত ফিকহ অধ্যয়নের প্রতি। শুরুতেই দ্বীনের জরুরি বিধানগুলো জানার চেষ্টা করুন। জরুরি বিধান বলতে বুঝাচ্ছি ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো, দৈনন্দিন জীবনের ইবাদাত-বন্দেগীর মাসআলা-মাসায়েলগুলো শিখুন। আপনি যে পেশার সাথে যুক্ত সেই পেশার যাবতীয় বিধি-বিধান জেনে নিন। কারণ ইসলাম একটি সামগ্রিক ধর্ম হলেও সামাজিক-জীবনে আমরা একে সুনির্ধারিত কিছু ইবাদতের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ করে রাখার মনোভাব পোষণ করি। যেনবা নামাজ-রোজা-হজ-যাকাত হলেই হয়ে গেল। এর বাইরে উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের তোয়াক্কা করা কিংবা ক্রয়-বিক্রয়ে ইসলামের বিধিনিষেধ মানার তেমন একটা গরজ অনুভব করি না আমরা।
সামগ্রিকভাবে দৈনন্দিন জীবনের মাসআলাগুলো জানার জন্য মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন সাহেবের লিখিত ‘আহকামে যিন্দেগী’ সামনে রাখতে পারেন। এটি যুগের চাহিদাকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে সহজভাবে লেখা। এতে মৌলিক প্রায় সব বিষয়ই মোটামুটি চলে এসেছে।
এক্ষেত্রে একটা নোট তৈরি করতে পারেন। কোন কোন বিষয়ে আপনার জানাশোনা কম, সেটা তালিকাবদ্ধ করে নিন এবং সেই বিষষের উপর বইপত্র সংগ্রহ করুন। আমরা অনেকে বই সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে ভুলটা করি তা হলো, সামনে যা পড়ে তাই কিনে নেই। অথবা যখন যেই বইয়ের আলোচনার ধুম পড়ে তখন তা কিনে আনি। এক্ষেত্রে পূর্বপরিকল্পনা বা বইটা আদৌ আমার দরকার আছে কিনা তা বিবেচনায় রাখি না। ফলে দেখা যায় একই বিষয়ে অনেক বই সংগ্রহে থাকলে অন্য অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়ে আমাদের সংগ্রহে কোন বই থাকে না। অথচ একই ধরনের অনেকগুলো বই সংগ্রহে থাকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে সব বিষয়ের কিছু কিছু থাকা।
তারপর হাদীস অধ্যয়ন করুন। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, শুরুতেই বুখারী শরীফের মতো গুরুগম্ভীর বই দিয়ে শুরু না করা। এতে নানানরকম প্রশ্নের ভেতর দিয়ে যেতে হবে আপনাকে, যা নিবিড়ভাবে হাদীস অধ্যয়নের গতিকে শ্লথ করে দিতে পারে। তাই ইমাম বুখারী রাহ. এর লিখিত সহীহ বুখারীর পরিবর্তে তাঁর লেখা অন্য একটি হাদীসগ্রন্থ ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ দিয়ে শুরু করতে পারেন। কিংবা ইমাম নববী রাহ. এর রিয়াজুস সালেহীন, ইমাম মুনযিরী রাহ. এর আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’ ইত্যাদি শিষ্টাচার ও আখলাক সংক্রান্ত হাদীসগ্রন্থগুলো আগে পাঠ করুন। এতে ফিকহী মতানৈক্য থেকে দূরে থাকতে পারবেন এবং হাদীসের সাথে আপনার মজবুত সম্পর্ক তৈরি হবে। কুতুবে সিত্তাহ থেকে পড়তে চাইলে এসব গ্রন্থের শিষ্টাচার সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো আগে পড়ে নেওয়া। শুরুতেই ফিকহী বিষয়ে অনুপ্রবেশ না করা। আমাদের অনেকেই কেবল ফিকহী মতানৈক্যকেন্দ্রিক হাদীসগুলোর উপর বেশি নজর দেন। অথচ এর বাইরে তরবিয়তকেন্দ্রিক অসংখ্য হাদীস আছে, সেগুলোর প্রতি অতোটা জোর দেননা। এমন মনোভাব পরিহার করা উচিত।
সীরাতপাঠ আমাদের পাঠ্যতালিকায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেন হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে ভুলবেন না। সীরাত পাঠের ক্ষেত্রেও আমার পরামর্শ থাকবে ছোট কোন সীরাত দিয়ে শুরু করুন। বিশাল বড় বিশ্বকোষে শুরুতেই হাত দিবেন না। তাহলে আপনার সীরাতপাঠ মাঠে মারা যেতে পারার আশঙ্কা আছে।
সীরাতগুলো দুই রকমের হয়ে থাকে।
ক. তারীখী,খ. আখলাকী
তারীখী সীরাতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবে কী করলেন না করলেন সেসবের বর্ণনা থাকে। এগুলো বর্ণনাকেন্দ্রিক হয়। ধারাবাহিকভাবে ঘটনার পর ঘটনা উল্লেখ হতে থাকে। আর আখলাকী সীরাতে নবী-জীবন থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। কোন ঘটনা থেকে আমরা কী শিখতে পারি এটা তুলে ধরাই থাকে এই ধারার সীরাতের মূখ্য উদ্দেশ্য। দুই রকমের সীরাতই অধ্যয়ন করা উচিত। কারণ নবীজি কবে কী করলেন এটা জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তারচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তার জীবনী থেকে আমাদের শেখার মতো কি কি আছে।
এর বাইরে আরেক রকম সীরাত আছে গল্পমূলক। এতে ধারাবাহিকভাবে জীবনচিত্র না তুলে ধরে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে তুলে ধরা হয়। এর সাথে অনেক সময় শিক্ষণীয় বিষয়গুলো থাকে, অনেক সময় থাকে না। বিশেষকরে সাহিত্যকে আশ্রয় করে এমন রচনা অধিক হয়ে থাকে। এই ধরনের রচনাকর্মে সাহিত্যটাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো হলো মৌলিক অধ্যয়নের অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে শরীয়তের একটি সামগ্রিক ধারণা চলে আসবে ইনশাআল্লাহ। এই ধাপ পাড়ি দেবার পর চাইলে আরেকটু বিস্তৃতির পথে হাঁটা যায়। সেক্ষেত্রে ইসলামী ইতিহাস, মনীষীদের জীবনীপাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন পাঠ্যতালিকাতে। বিশেষকরে হিজরী প্রথম তিন শতকের ইতিহাস।
কুরআনের ক্ষেত্রে কুরআন সংকলনের ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেওয়া, হাদীস সংকলনের ইতিহাস ও এর ধারা-পরিক্রমা, প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের জীবনী ও তাদের সংকলিত গ্রন্থ সম্পর্কে সবিস্তর ধারণা লাভ। ফিকহের ক্ষেত্রে ফিকহ সংকলকের ইতিহাস ও এর ধারা-পরিক্রমা, ইসলামী দুনিয়ার বিভিন্ন ফিকহী মাযহাব তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট, আদাবুল ইখতিলাফ বা মতানৈক্যের শিষ্টাচার ইত্যাদি সম্পর্কে পড়াশোনা করা।
সামগ্রিক অধ্যয়নের পাশাপাশি মৌসুমী-অধ্যয়নে প্রতিও মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। মৌসুমী-অধ্যয়ন বলতে বুঝাচ্ছি, যখন যেই প্রসঙ্গ সামনে আসে তখন সেই বিষয়ে আদ্যোপান্ত পড়ে নেওয়া। যেমন- রমজানের মৌসুম এলে রোজা সংক্রান্ত মাসায়েল-ফাজায়েলগুলো পড়ে নেওয়া। কুরবানী এলে কুরআনির পশু, কুরবানী ও এতসংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়ের মাসায়েলগুলো পড়ে নেওয়া। এভাবে মুহাররম-আশুরা, শবে বরাত যখন যেটা সামনে আসে সেই সম্পর্কে পড়ে নেওয়া। দিবস-কেন্দ্রিক বিষয়ের বাইরে ইস্যু-কেন্দ্রিক অধ্যয়নও ফায়দাজনক। যেমন শাতিমে রাসুলের ইস্যু সামনে এলো, সুতরাং সেই বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করে নেওয়া।
এভাবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অধীনে কেউ যদি তার দ্বীনী ইলমচর্চা অব্যাহত রাখে, তাহলে আশা করা যায় দ্বীন ও শরীয়তের সামগ্রিক একটি বুঝ তার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে এবং তার দ্বীনের পথে চলা অনেক অটল-অবিচল হবে। আল্লাহ তাওফীক দান করু। আমিন।