হাদিস গ্রহণ-বর্জন ও পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ফিকহে হানাফিতে যে উসুল ও নীতিমালা অনুসরণ করা হয় তা পরবর্তী মুহাদ্দিসদের নীতিমালার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতর।
সপ্তম শতকের ইবনুস সালাহ বা নবম শতকের ইবনে হাজারের বর্ণনাকৃত নীতিমালার আলোকেই সাধারণত মুহাদ্দিসরা হাদিস পর্যালোচনা করে থাকেন। আর সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই হানাফিদের নীতিমালার চেয়ে বেশ আলাদা।
উদাহরণ দিচ্ছি, পরবর্তী মুহাদ্দিসরা হাদিসকে প্রথমত দুইভাগে ভাগ করেন। খবারে মুতাওয়াতির ও খবারে ওয়াহেদ। এরপরে খবারে ওয়াহেদকে আবার তিনভাগে ভাগ করেন। মশহুর, আযিয,গরিব। তাহলে আমরা দেখতে পেলাম, তাদের নীতিমালার আলোকে মশহুর মূলত খাবারে ওয়াহেদেরই একটা প্রকার। একটা অপরটার বিপরীত কিছু নয়।
এবার আসুন ফিকহী হানাফিতে অনুসৃত নীতিমালার প্রতি আমরা দৃষ্টি দেই। তারা প্রথমেই হাদিসকে তিনভাগে ভাগ করেন। খবারে মুতাওয়াতির, খবারে মশহুর ও খবারে ওয়াহেদ। এখানে কিন্তু খবারে মশহুরটি খবারে ওয়াহেদ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রকার। একটি অপরটির বিপরীত।
হানাফিদের অনুসৃত নীতিমালার আলোকে খবারে মশহুরের মাধ্যমে কুরআনের উপর কোন কিছু বৃদ্ধি করা বৈধ। এখন যিনি উপরের বর্ণিত পার্থক্যটা সম্পর্কে ধারণা রাখেন না কিন্তু এই নীতিমালাটা জানেন তিনি কী করবেন? পরবর্তী মুহাদ্দিসরা যাকে মশহুর বলেছেন সেই হাদিসের মাধ্যমে কুরআনের উপর কিছু বৃদ্ধি করতে চাইবেন। কিন্তু যখন দেখবেন হানাফিরা সেটা মানতে চাচ্ছে না তখন সে বলে দিবে, ধুর মিয়া! তোমরা তো বলো মশহুরের মাধ্যমে কুরআনের উপর বৃদ্ধি করা বৈধ। তাহলে এখন মানো না কেন? অথচ এই আল্লাহর বান্দার খবরই নেই যে, সে যে মশহুর দিয়ে বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে তা হল পরবর্তী মুহাদ্দিসদের পরিভাষার মশহুর। ফিকহে হানাফির নীতিমালাতে সেটা তো খবারে ওয়াহেদ বলে বিবেচিত। যার দ্বারা কুরআনের উপর কিছু বৃদ্ধি করা বৈধ বলে তারা মনে করে না।
এটা শুধু একটা বিষয়ে বললাম। এমন আরো বহু বিষয় রয়েছে যেখানে ফিকহে হানাফির নীতিমালার সাথে পরবর্তী মুহাদ্দিসদের নীতিমালার পার্থক্য রয়েছে। তো যারা এটা জানে না তারা অভিযোগ করে থাকেন, ফিকহে হানাফিতে বহু সহিহ হাদিস গ্রহণ করা হয় নি। তারা শুধু যঈফ হাদিস গ্রহণ করে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা মূলত পরবর্তী মুহাদ্দিসদের নীতিমালার আলোকে ফিকহে হানাফিকে বিচার করতে যাবার কারণে এসব অভিযোগের উদ্ভব হয়।
সুতরাং আপনি যদি ফিকহে হানাফিকে বুঝতে চান তবে আপনাকে তাদের অনুসৃত নীতিমালার আলোকেই বুঝতে হবে। অন্যদের নীতিমালার আলোকে বুঝতে গেলে শুধু ভুলই বুঝবেন। সঠিক বিষয় থেকে যোজন যোজন দূরে থাকবেন।
দুঃখের কথা হল, অধিকাংশ হানাফি আলেম ও তালিবুল ইলমরাও এসব বিষয়ে সবিস্তারে অবগত নন। ফলে অনেক সময় তারাও বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। কারণ মাদরাসাতে ইবনে হাজার রাহ. এর নুখবাতুল ফিকার পড়ে সেই আলোকে ফিকহে হানাফি বুঝতে যায়। অথচ নুখবাতুল ফিকার হল পরবর্তী মুহাদ্দিসদের নীতিমালার আলোকে রচিত গ্রন্থ। সেটা দিয়ে ফিকহে হানাফিকে বুঝতে গেলে সমস্যা তো হবেই। আর বাস্তবে হচ্ছেও অনেক জায়গায়।
আমার মনে হয়, যেসব ছেলে প্রথমে হানাফি ছিল পরে আহলে হাদিস বা সালাফিয়তের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে তার প্রথম ও প্রধান কারণ হল এটাই যে সে পরবর্তীদের উসুল বা নীতিমালা দিয়ে ফিকহে হানাফিকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং আমি সবসময় ইমাম মুহাম্মাদ রাহ, এর মতো করে বলি, ইয়া আখি, লা তাশহাদ আলাইনা হাত্তা তাসমাআ মিন্না… ভাই, আমাদের বক্তব্য না শুনে, আমাদের নীতিমালা না জেনে আমাদের বিপক্ষে কিছু বলবেন না।
তালিবুল ইলমরা এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে “দিরাসাত ফি উসুলিল হাদিস আলা মানহাজিল হানাফিইয়া” ও “মানহাজুল হানাফিইয়া ফি নকদিল হাদিস” কিতাব দুটি দেখতে পারেন।