পি কে হিট্টি নিকট অতীতের অন্যতম সেরা একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। লেবানিজ বংশদ্ভুত আমেরিকান এই লেখক কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিটিক সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর মহত্তর প্রচেষ্টার ফলেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় আজ আরবী পাণ্ডুলিপির একটি অমূল্য সংগ্রহ-ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে হিট্টি অবসর গ্রহণ করেন। আরব জাতি, তাদের জীবন সাধনা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং বিশেষভাবে ইসলাম ধর্মের বিকাশ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তার ব্যাপক ও বিস্তৃত অধ্যয়ন ছিল।
পি কে হিট্টির লেখা আরব জাতির ইতিহাস বইটি আমাদের দেশে তো বটেই, সারা বিশ্বেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। ইসলামের ইতিহাসের জন্য একে অনেকে আকরগ্রন্থের মর্যাদা দিয়েছে। বইটি রচনায় হিট্টি দশ দশ বছর সময় নেন। ১৯৩৭ সালে প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ম্যাকমিলান কর্তৃক লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে এটি একযোগে প্রথম প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে সাড়া পড়ে যায়। এই পর্যন্ত শুধু মূল ইংরেজি সংস্করণেরই লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে বইটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ (দি এ্যারাবস, এ শর্ট হিস্ট্রি) বের হওয়ার পর বহু সংস্করণে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর বহু ইউরোপীয় ও এশীয় ভাষায় এর অনেকগুলো অনূদিত সংস্করণ বেরিয়েছে। এ ভাষাগুলোর মধ্যে ফরাসী, স্পেনিশ, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, আরবী, উর্দু, বাংলা ও ইন্দোনেশীয় ভাষা উল্লেখযোগ্য।
ইংরেজি শিক্ষিত যারাই ইসলামের ইতিহাস নিয়ে বই রচনা করেছে, তাদের নগন্য সংখ্যাই এমন আছে, যারা এটি পড়েনি বা এর থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেনি। ইসলাম ও মুসলমানের বিকাশধারা বুঝতে হাজার হাজার মানুষ আজও এই বইটির ধারস্থ হচ্ছে। ১৯৫৯ সালে প্রথম প্রকাশের পর এর বিভিন্ন অধ্যায় মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়।[1] এর থেকেও অনুমিত হয়, ইসলামী ইতিহাসের পাঠ্যবইগুলো রচনাতে এর প্রভাব রয়েছে।
বাংলাভাষায় এর বেশ কয়েকটি অনুবাদ আছে। সংক্ষিপ্ত ভার্সনের অনুবাদ করেছেন নন্দিত ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ। এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণের বাংলা ভূমিকাতে ‘মুহাম্মদ : আল্লাহর রাসূল’ অধ্যায়ের প্রসংশা করে বলা হয়েছে, ‘রাসূল (সা.)-এর অধ্যায়টি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্বলিত বিচার বিশ্লেষণে নির্মোহ দৃষ্টিতে রাহমাতুল্লিল আলামিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানব জাতির ত্রাতা হিসেবে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা উঠে এসেছে। কিতাব ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক অনুসন্ধানে হিট্টি সংশ্লিষ্ট গোত্র বা সম্প্রদায়ের জীবনাচার ও সংস্কৃতির সাযুজ্য সাধনে আসমানী কিতাবসমূহের অবিসংবাদিত ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন।’[2]
পুরো বইটি নিয়ে এখানে পর্যালোচনা করার সুযোগ নেই। আমি শুধু ‘মুহাম্মদ : আল্লাহর রাসূল’ এই অধ্যায়টুকু পর্যালোচনা করব।[3] যাতে পাঠক অনুমান করতে পারেন, প্রাচ্যবিদদের রচনাবলীর মাধ্যমে কীভাবে নানান ভুল-ভ্রান্তি ও বিষাক্ত বিষয় মুসলিম সমাজের মধ্যে অনুপ্রবেশ করছে। এই বইটি চিত্তাকর্ষক বর্ণনাভঙ্গিতে রচিত ও মাঝেসাঝে ইসলামের নবী, ইসলাম ইত্যাদি নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা ও মূল্যায়ন রয়েছে। কিন্তু এই সুন্দর সুন্দর কথার ভেতর দিয়েই হঠাৎ হঠাৎ লেখক পরিমিত পরিমাণ বিষ ঢেলে দেন। যেন খুব সূক্ষ্মবোধের অধিকারী না হলে একজন সাধারণ পাঠক সহজে তা ধরতে না পারে। এ যেন আবুল হাসান আলী নাদবী রাহ. সেই উক্তির বাস্তব উদাহরণ, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘অনেক প্রাচ্যবিদ তাদের লেখায় নির্দিষ্ট পরিমাণে বিষ মিশিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা খুব সতর্কতা অবলম্বন করেন। নির্ধারিত পরিমাণের চাইতে বেশি (তথ্য) বিষ প্রয়োগ করেন না, যাতে পাঠক নি:সঙ্গতা অনুভব না করে, সতর্ক হয়ে না যায় এবং লেখকের স্বচ্ছতার প্রতি তার যে আস্থা তা যেন দুর্বল হয়ে না পড়ে।’[4]
কুরআনে বর্ণিত তারগীব-তারহীব তথা সুসংবাদ ও ভীতিপ্রদ আয়াতগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে এমন শব্দচয়ন করা হয়েছে, সাধারণভাবে পড়লে মনে হয় নবীজি সা. নিজের পক্ষ থেকে স্বীয় স্বার্থ রক্ষার্থে কৌশল হিসেবে এমনটি করেছেন। এটি যে আল্লাহর বাণী এবং এতে নবীজির বিন্দুমাত্রও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ ছিল না, তা বুঝাই যায় না। বরং উল্টো কিছুই বুঝা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর বার্তাবহ (রাসূল) হিসেবে নতুন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করার পর মুহাম্মাদ তাঁর নিজের মানুষদের মধ্যে নতুন বাণীর প্রচার, প্রসার ও শিক্ষার কাজে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তারা তাঁর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্রূপের বাণ হানতে লাগল। ফলে তিনি নিজেকে নাযীর (কোরান ৬৭:২৬, ৫১:৫০, ৫১) সতর্ককারী ও শেষ বিচারের তত্ত্ববাহক রূপে বেহেশতের মনোরম বর্ণনা এবং দোজখের ভীতিপ্রদ অবস্থা বর্ণনা করে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এমনকী তাঁর শ্রোতাদের আসন্ন বিপদের ভয় দেখিয়ে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।’[5]
রাসূলুল্লাহ সা. এর অন্যতম মুজিযা ছিল মিরাজ। যাকে ইসরা নামেও ডাকা হয়। মক্কী জীবনে এই ঘটনাটি ঘটেছিল। মক্কার মসজিদে হারাম থেকে প্রথমে বাইতুল মুকাদ্দাস তারপর সেখান থেকে সপ্তাকাশে ভ্রমণ করেন তিনি। এর কথা কুরআনেও এসেছে। সূরা ইসরাতে বলা হয়েছে,
سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِهٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ
‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’[6]
অনেকগুলো সহীহ হাদীসেও এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সহীহ বুখারীতে আবূ যার রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তখন আমি মক্কায় ছিলাম। জিবরীল এসে আমার বক্ষ বিদীর্ণ করলে ন। আর তা যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেন। এরপর হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ একটি সোনার পাত্র নিয়ে আসলেন এবং তা আমার বক্ষে ঢেলে দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। তারপর হাত ধরে আমাকে দুনিয়ার আসমানের দিকে নিয়ে চললেন…।[7]
ইসরা ও মিরাজের ঘটনা একজন মুমিনের জন্য আকীদার অন্যতম গুরত্বপূর্ণ অংশ। এতে সন্দেহ পোষণ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। এই বিষয়টিকে পি কে হিট্টি এমনভাবে বর্ণনা করেছে, যেন এটি একটি লোকগাঁথা, একটি কল্পকাহিনী (dramatic isra)। অনুবাদকও পারঙ্গমতার সাথে ‘নাকি’ শব্দের হাতুড়ি দিয়ে ইসরার ঘটনার বাস্তবতাকে আঘাত করার হিট্টির প্রচেষ্টাকে শিল্পিত রূপ দিলেন। যেনবা এটি একটি মিথ মাত্র, যা বলতে শোনা যায়। এর সত্যতার উপর খুব সূক্ষ্মভাবে একটা অবিশ্বাসের আবরণ ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। হুবহু বক্তব্যটা দেখে নেওয়া যাক –‘হিজরতপূর্ব এই সময়েই সেই নাটকীয় ইসরা অর্থাৎ সেই নৈশ অভিযান ঘটেছিল। বলা হয়, সপ্তম স্বর্গে আরোহণের সময় মুহাম্মদ নাকি চোখের পলকে আল-কাবা থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন।’[8]
পি কে হিট্টির চতুরতার জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত হচ্ছে বনু কুরাইযার ঘটনার উল্লেখ। তার বিবরণ দেখার আগে মূল ঘটনা জেনে নেওয়া যাক। হিজরতের তম বছরে মুশরিকদের সম্মিলিত বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে। ইহুদীদের সাথে চুক্তি ছিল, মদীনা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে তা রক্ষা করবে। কিন্তু ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযা ভেবেছিল, এবার যেহেতু সম্মিলিত বাহিনী মিলে আক্রমণ করেছে, এবার মুসলিমদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই তারা মক্কার মুশরিকদের সাথে হাত মিলায় এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলে যায়। খন্দকের যুদ্ধের সমাপ্তির পর রাসূল সা. সাহাবীদের নিয়ে বনু কুরাইযাকে শায়েস্তা করতে তাদের বস্তিতে আগমন করেন এবং তাদেরকে অবরোধ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ইহুদী নেতা কাব বিন আসাদ তাদের সামনে তিনটি প্রস্তাব উপস্থাপন করল। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমে:
১. ইসলাম গ্রহণ করে মুহাম্মাদ সা. এর দ্বীনে প্রবেশ করে স্বীয় জানমাল এবং সন্তান-সন্ততিকে ধ্বংসপ্রাপ্তির হাত থেকে রক্ষা করবে। এ প্রস্তাব উপস্থাপন কালে কাব বিন আসাদ এ কথাও বলেছিল যে, ‘আল্লাহর শপথ! তোমাদের নিকট এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তিনি হচ্ছেন প্রকৃতই একজন নবী এবং রাসূল। অধিকন্তু তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যার সম্পর্কে তোমরা আল্লাহর কিতাবে অবগত হয়েছ।’
২. অথবা স্বীয় সন্তান-সন্তুতিকে স্বহস্তে হত্যা করবে। অতঃপর তলোয়ার উত্তোলন করে নবী সা. এর দিকে অগ্রসর হয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করবে। পরিণামে বিজয়ী হবে, নতুবা সমূলে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
৩. অথবা রাসূলুল্লাহ সা. এবং সাহাবাদেরকে ধোঁকা দিয়ে শনিবার দিনে তাদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করবে। কারণ এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিন্ত থাকবেন যে, এ দিনে কোন যুদ্ধ বিগ্রহ অনুষ্ঠিত হবে না। যেহেতু এই দিন ইহুদীদের কাছে পবিত্র।[9]
কিন্তু ইহুদীগণ এ তিনটি প্রস্তাবের একটিও মঞ্জুর করল না। শেষপর্যন্ত তারা রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট অস্ত্রসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল এবং তিনি যা উপযুক্ত বিবেচনা করবেন তা তারা নির্বিবাদে মেনে নেবে বলে স্থির করল। রাসূল সা. তাদের ব্যাপারে নিজে কোন ফয়সালা করলেন না। বরং বনূ কুরাইযার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হলো, তাদের ব্যাপারে আওস গোত্রের সর্দার সাদ ইবনে মুআয রা. যেরূপ বিচার করবেন তারা তা মেনে নিবে। তাই রসূল সা. তাদের বিচার ও শাস্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্তের ভার সাদ রা. এর উপর অর্পণ করেন। যেহেতু বনু কুরাইযার সাথে আওস গোত্রের জাহেলী যামানায় বন্ধুত্ব-চুক্তি ছিল, তাই তাদের আশা ছিল, তিনি তাদের ব্যাপারে সহজতর কোন ফয়সালা দিবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল পুরোই উল্টো। তিনি বললেন, ‘তাদের সম্পর্কে আমার বিচারের রায় হচ্ছে, তাদের পুরুষদের হত্যা করা হোক, মহিলা ও শিশুদের বন্দী করে রাখা হোক এবং সম্পদসমূহ বন্টন করে দেয়া হোক।’ এই ফয়সালার ফলে বনু কুরাইযার ছয়শর বেশি পুরুষকে হত্যা করা হয়।[10]
পি কে হিট্টি এই ঘটনাকে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘বনু কুরাইযা ছিল ইসলামের শত্রুদের মধ্যে প্রথম উপজাতি, যাদের স্বধর্ম ত্যাগের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। অথবা বিকল্প হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল।’[11]
তার লেখা পড়লে মনে হয়, বনু কুরাইযাকে মুসলিমদের পক্ষ থেকে দুইটা অপশন দেওয়া হয়েছিল। হয়ত ইসলাম গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় মৃত্যুকে বেছে নিতে হবে। এটা কেমন যেন তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক মুসলিম বানানোর অভিযোগের পক্ষে একটা দলিল হয়। অথচ বাস্তবতা হলো, বনু কুরাইযাকে মুসলিমদের পক্ষ থেকে এমন কোন প্রস্তাবই দেওয়া হয়নি। বরং সাদ ইবনে মুআয রা. সরাসরি যুদ্ধবন্দি সক্ষম পুরুষদের হত্যার ফয়সালা দিয়েছিলেন। যেমনটা বিস্তারিত আমরা মাত্রই দেখে আসলাম।
এই ধরনের একটা পরামর্শ বা প্রস্তাব তাদের নেতা কাব বিন আসাদ তাদেরকে দিয়েছিল। সেটা তারা গ্রহণ করেনি। কিন্তু বইতে বিষয়টাকে এমনভাবে কর্তা উহ্য রেখে (passive voice) বর্ণনা করা হয়েছে যে, প্রস্তাবটা কার পক্ষ থেকে তা স্পষ্ট না। বরং সাধারণভাবে এটাই মনে হয় যে, তা মুসলিমদের পক্ষ থেকেই ছিল। আবার এটা নিয়ে আপত্তি করা হলে অস্বীকার করার একটা সুযোগও থেকে যায়। মানে, সাপও মরল লাঠিও ভাঙ্গল না।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বর্ণনার ঠিক আগের লাইনের ও পরের লাইনের পৃথক পৃথক রেফারেন্স উল্লেখ করলেও মাঝের শুধু এই লাইনটিতে তিনি কোন রেফারেন্স উল্লেখ করেননি। কেননা যদি রেফারেন্স উল্লেখ করতেন তাহলে পুরো বিষয়টি একদিকে নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না’ খেলাটা আর খেলতে পারতেন না।
হিট্টির চতুরতার আরেকটি উদাহরণ হলো, মারিয়া কিবতিয়াকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নবীজির মিশরদেশীয় খ্রিস্টান স্ত্রী হিসেবে।[12] বাদশা মুকাওকিস তাকে নবীজির জন্য উপহার হিসেবে পাঠান। বাস্তবতা হলো, তিনি শুরুতে খ্রস্টান থাকলেও মদীনায় আসার আগেই ইসলাম গ্রহণ করে নেন। নবীজির দূত হাতিব ইবনে আবি বালতাআ তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলে তিনি সাদরে তা গ্রহণ করে নেন।[13] হিট্টি এই বিষয়টিকে আড়াল করে তার পূর্বপরিচয় দিয়েই তাকে বইতে পেশ করে। যেন কোন খ্রিস্টান মহিলাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করাটা পাঠকের সামনে স্বাভাবিক একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়।
পবিত্র কাবা ঘরে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে হিট্টির বক্তব্য হচ্ছে, ‘ইসলাম পূর্ব যুগের অন্ধভক্তি থেকে উদ্ভূত কালো পাথরকে চুম্বন করার প্রথাটিও অনুমোদন পেল।’[14]
তার কথা থেকে অনুমিত হয় এই পাথরের প্রতি ভক্তিটা অন্ধভক্তি থেকে সৃষ্ট, এর পেছনে ভিন্ন কোন কারণ নেই। কিন্তু ইসলাম আমাদেরকে অন্য কথা বলে। এই পাথর সাধারণ কোন পাথর নয়। কাবা ঘর নির্মাণের পর জিবরীল আ. তা জান্নাত থেকে নিয়ে এসে ইবরাহীম আ. কে দিয়েছিলেন এবং তিনি তা কাবা ঘরের এক কোনায় স্থাপন করেছিলেন।[15] সুতরাং এটি পৌত্তলিকদের সাধারণ কোন জিনিসকে অসাধারণ মনে করে অন্ধভক্তি থেকে পূজা করার মত বস্তু নয়।
হাদীসের গ্রন্থগুলোতেও হাজরে আসওয়াদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা এসেছে। রাসুল সা. বলেছেন, ‘হাজরে আসওয়াদ একটি জান্নাতি পাথর, তার রং দুধের চেয়ে বেশি সাদা ছিল। এরপর বনি আদমের পাপরাশি একে কালো বানিয়ে দিয়েছে।’[16]
অন্য হাদীস থেকে জানা যায়, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা বরকতময়। রাসুল সা. বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন এ পাথর আবু কুবাইস পাহাড় থেকে বড় আকার ধারণ করে উপস্থিত হবে। তার একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট থাকবে, (বায়তুল্লাহর জিয়ারতকারীরা) কে কোন নিয়তে তাকে চুম্বন করেছে, সে সম্পর্কে বক্তব্য দেবে।’[17]
৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়াতে মুসলিম ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। সেই সন্ধির ব্যাপারে হিট্টির বক্তব্য হলো, ‘মুহাম্মদ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তার একদল অনুগামীকে নিয়ে মক্কা থেকে ৯ মাইল দূরে অবস্থিত আল-হুদাইবিয়ায় এসে পৌঁছালেন এবং সেখানে একটি চুক্তি সাক্ষর করলেন, যাতে মক্কার অধিবাসী ও মুসলিমদের সমান অধিকার দেওয়া হল।[18]
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সন্ধিচুক্তিতে মুসলিমদের তুলনায় কাফেররা অধিক সুবিধা লাভ করেছে। সেই চুক্তির ধারাগুলো ছিল নিম্নরূপ-
১. মদীনার মুসলমান ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত সকল প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকবে।
২. এই বছর মুসলমানরা উমরা না করেই মদীনায় ফেরত যাবেন।
৩. আগামী বছর তারা মক্কায় আগমণ করতে পারবেন। এ সময় তারা সাথে তীর ও বর্শা আনতে পারবেন না। আত্মরক্ষার জন্য শুধু কোষবদ্ধ তলোয়ার সাথে রাখতে পারবে।
৪. মক্কায় তারা কেবল তিন দিন অবস্থান করতে পারবেন। তিন দিন পার হওয়ার সাথে সাথে মক্কা থেকে বের হয়ে চলে যেতে হবে।
৫. এই দশ বছরের মধ্যে মক্কার কোন লোক যদি মুসলমান হয়ে মদীনায় আশ্রয় নেয় তাহলে মদীনাবাসীগণ তাকে আশ্রয় দিবে না। পক্ষান্তরে মদীনার কোন লোক যদি মক্কায় চলে আসে তাহলে মক্কাবাসীগণ তাকে মদীনায় ফেরত দিবে না।
এই ধারাগুলোর মধ্যে শেষ ধারাটি ছিল সবচে বেশি অসম। এটি বাহ্যিকভাবে পুরো মুসলিমদের বিপক্ষে ছিল। তবুও নবীজি উভয় পক্ষের কল্যাণ চিন্তায় কুরাইশদের দাবী মেনে নিয়েছিলেন। চুক্তির সবগুলো ধারাকে সামনে রাখলে এটাই মনে হয় যে, এটি মক্কার অধিবাসী ও মুসলিমদের সমান অধিকারপূর্ণ ছিল না। সেজন্যই চুক্তি সম্পাদনের পর সাহাবীরা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ ছিল।[19] যদিও পরবর্তীতে এই অসম চুক্তিই দীর্ঘ মেয়াদে মুসলিমদের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছিল।
তবে এটা ঠিক, হিট্টির এই বইতে খুব সাধারণ আলোচনার ভেতর দিয়ে আরব ও মুসলিমদের লম্বা ইতিহাসকে চমৎকার ভঙ্গিতে অল্প কথায় তুলে আনতে পেরেছেন। এমন অনেক দুর্লভ তথ্যও তিনি এতে সন্নিবেশিত করেছেন, যা সাধারণত অন্য বইতে পাওয়া যায় না। যেমন হারামের সীমানায় অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধের আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে লিখেছেন, ‘প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অনধিক ১৫জন ইউরোপিয় খ্রিস্টান দুটি পবিত্র নগরী (মক্কা-মদিনা) দেখতে সক্ষম হয়েছেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম হলেন বোলোন্যার লুডোভিকো ডি ভারথেমা (১৫০৩ খ্রি.) পরবর্তীকালে সেখানে এলডন রুটার নামে এক ইংরেজ এবং জুলিয়াস জার্মানাস পৌঁছাতে সফল হয়েছিলেন। তবে সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক ভ্রমণকারী ছিলেন স্যার রিচার্ড বারটন (১৮৫৩ খ্রি.)।[20]
এসব ব্যতিক্রমধর্মী কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে তার এই বই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং অন্যতম আকর গ্রন্থের মর্যাদা পায় অনেকের কাছে। কিন্তু এর নির্ভরযোগ্যতার অবস্থা কেমন, উপরের পর্যালোচনা থেকে আশা করি বুঝতে পারছেন। তাই গবেষক ও আগে থেকে সীরাত এবং ইসলামী ইতিহাস বিষয়ে যথেষ্ট জানাশোনা ও স্বচ্ছ ধারণা আছে এমন লোক ছাড়া অন্য কারো জন্য প্রাচ্যবিদদের লেখা এসব বই পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করা মোটেই উচিত নয়।
[1] আরব জাতির ইতিহাস; জ্ঞান বিতরণী প্রকাশনী, মহাম্মদ আবদুল মজিদের লেখা ভূমিকা থেকে
[2] আরব জাতির ইতিহাস : ১০; প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ অনূদিত, জ্ঞান বিতরণী প্রকাশনী
[3] পর্যালোচনার জন্য সংক্ষিপ্ত ভার্সনের পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ ভার্সনটিকেই আমি নির্বাচিত করেছি। এর একাধিক অনুবাদের মধ্যে কলকাতার মল্লিক ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত অনুবাদ থেকেই কোট করেছি। কারণ অনলাইনে এই প্রকাশনীর বইটিই ছিল সহজলভ্য। আর বাংলার পাশাপাশি সরাসরি মূল বই (History of The Arabs: from the earliest times to the present) থেকেও নির্বাচিত বর্ণনাটুকু তুলে ধরব। এটি নেওয়া হয়েছে 1970 সালে প্রকাশিত এই বইয়ের দশম সংস্করণ থেকে।
[4] মুসলিম লেখক ও প্রাচ্যবিদদের ইসলাম বিষয়ক গবেষণাকর্ম মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা, আবুল হাসান আলী নদভী : ১৮ (মুহাম্মদ ব্রাদার্স, প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০১৫)
[5] আরব জাতির ইতিহাস : ১২৩; মল্লিক ব্রাদার্স
[6] সূরা আল-ইসরা : ০১
[7] আস-সহীহ, বুখারী : ৩৪২
[8] আরব জাতির ইতিহাস : ১২৪; মল্লিক ব্রাদার্স। মূল ইংরেজি পাঠ- Within this pre-Hijrah period there also falls the dramatic isra, that nocturnal journey in which the Prophet is said to have been instantly transported from al-Ka’bah to Jerusalem preliminary to his ascent (miraj) to the seventh heaven. (History of The Arabs, philip K. Hitti, p: 114)
[9] আস-সীরাতুন নাবাওিয়্যাহ, ইবনু হিশাম : ২/২৩৬
[10] আস-সীরাতুন নাবাওিয়্যাহ, ইবনু হিশাম : ২/২৪১
[11] আরব জাতির ইতিহাস : ১২৭; মল্লিক ব্রাদার্স। মূল ইংরেজি পাঠ- The banu-Qurayzah were the first but not the last body of Islam’s foes to be offered the alternative of apostasy or death. (History of The Arabs, philip K. Hitti, p: 11৭)
[12] ‘তার মিশরদেশীয় খ্রস্টান স্ত্রী মেরির গর্ভজাত শিশুপুত্র ইবরাহীমের মৃত্যুতে মুহাম্মদ তীব্র শোকাহত হয়েছিলেন।’ আরব জাতির ইতিহাস : ১২৯; মল্লিক ব্রাদার্স। মূল ইংরেজি পাঠ- mohammad mourned bitterly the loss of his infant son, Ibrahim, born to him by mary, a Chirstian Copt (History of The Arabs, philip K. Hitti, p: 1২০)
[13] আত-ত্ববাকাতুল কুবরা, ইবনু সাদ : ৮/২১২; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনু কাসীর : ৮/২২৯; আল-ইসাবাহ ফি তামইয়ীযিস সাহাবাহ, ইবনু হাজার : ৮/৩৩১; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী : ১/২৯৯
[14] আরব জাতির ইতিহাস : ১২৭; মল্লিক ব্রাদার্স। মূল ইংরেজি পাঠ- The black stone – a pre-islamic fetish- sanctioned (History of The Arabs, philip K. Hitti, p: 1২০)
[15] আল-মুসান্নাফ, ইবনু আবি শাইবাহ, বর্ণনা নং- ১৪১৪৪
[16] আস-সুনান, তিরমিযী : ৮৭৭, আল-মুসনাদ, আহমাদ : ১/৩০৭, ৩২৯
[17] সহীহ ইবনু খুযাইমা : ৪/২২১, আল-মুসতাদরাক, হাকিম : ১/৪৫৭
[18] আরব জাতির ইতিহাস : ১২৭; মল্লিক ব্রাদার্স। মূল ইংরেজি পাঠ- In 628 Muhammed led a band of believers to a settlement, Al-Hudaybiyah, nine miles from Makkah and exacted a pact in which Makkans and Moslems were treated on equal terms (History of The Arabs, philip K. Hitti, p: 1১৮)
[19] আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ইবনু হিশাম : ২/৩১৮
[20] আরব জাতির ইতিহাস : ১২৮; মল্লিক ব্রাদার্স।