মানবজাতির দুনিয়ায় আগমনের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে; তা হলো, আল্লাহ তাআলার ইবাদাত করার মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ.
“আর আমি কেবল আমার ইবাদাত করার জন্যই জিন ও মানুষদের সৃষ্টি করেছি।”[1]
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে—
فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ.
“যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই সফলকাম।”[2]
এই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে মানুষ দুনিয়ার বুকে নানারূপ বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়। অনেক ধরনের সমস্যা ও প্রতিকূলতার মুকাবিলা করতে হয় তাকে। সে-জন্যই একজন মানুষের শুধু ঈমান আনয়ন করার মাধ্যমেই সফলতা অর্জিত হয়ে যায় না, বরং তাকে ঝাঁপ দিতে হয় সংগ্রামে। লড়াই করতে হয় নিজের নফস, শয়তান ও দুনিয়ার তৈরি করে দেওয়া কুপ্রথা, সামাজিক কুসংস্কার ও অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে। এটাই হলো আল্লাহর পক্ষ থেক আগত একজন মুমিনের জন্য পরীক্ষা।
আল্লাহ তাআলা এই বিষয়ে ইরশাদ করেন—
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِين
“মানুষ কি ধারণা করে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং তিনি অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।”[3]
একজন মুমিন যখন দ্বীন পালনে সচেষ্ট হয়, তখন চারপাশ থেকে আপত্তি আর বিপত্তির তির ছুটে আসতে থাকে তার দিকে। সবাই তাকে বয়কট করা শুরু করে। তাকে দেখলে এড়িয়ে চলে। কথা বলতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হাজারও মানুষের ভিড়ে সে যেন একাকী এক প্রাণী।
সময়ের দাঁড় টেনে দিন যত সামনে এগুচ্ছে, ততই যেন এই চিত্র প্রকট হচ্ছে আমাদের সমাজে, দুনিয়ার বুকে। স্কুল-কলেজ বা ভার্সিটিতে পড়া একটি ছেলে যখন দাড়ি রাখা শুরু করে, তখন বন্ধু-বান্ধব তো বটেই, অনেক সময় পরিবারের লোকেরাও তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে শুরু করে। তার পাশে বসে না। তার কাছে ঘেঁষে না। অনেকে আবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বিভিন্ন কটু কথা শুনিয়ে দেয়। সুযোগ পেলে ‘জঙ্গি’ বলে টিপ্পনী কাটতে ভুল করে না— যেন সে দাড়ি রেখে মস্ত বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। এমনিভাবে একটি মেয়ে পর্দা করা শুরু করলে তাকেও পোহাতে হয় নানান রকম দুর্ভোগ। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে টিচাররা পর্যন্ত তাকে হেনস্তা করে অনেক সময়। বাজে মন্তব্য আর বিভিন্ন অমূলক সন্দেহের বুলেটে ঝাঁঝরা হতে হয় তাকে প্রতিনিয়ত। এটা আমাদের সমাজের নিত্য দিনের চিত্র। এই চিত্র দিন যত যাবে, তত গাঢ় হবে। তত বেশি অসহ্যকর হয়ে উঠবে। কিন্তু এতে খুব বেশি ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এমন পরিস্থিতিতে যারা নিজেদের দ্বীনকে আঁকড়ে ধরবে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য সান্ত্বনার বাণী রেখে গেছেন। তাদের জন্য করেছেন বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা।
তিনি বলেছেন, ‘তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে থাকো। অবশেষে যখন তুমি (লোকদেরকে) কৃপণতার আনুগত্য, প্রবৃত্তির অনুসরণ, পার্থিব স্বার্থকে অগ্রাধিকার এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের মতামতের ব্যাপারে আত্মমগ্ন দেখতে পাবে এবং এমন সব গর্হিত কাজ হতে দেখবে, যা প্রতিহত করার সামর্থ্য তোমার নেই—এমন পরিস্থিতিতে তুমি নিজের বিষয়ে খেয়াল রাখবে আর সর্বসাধারণের চিন্তা ছেড়ে দেবে। কেননা তোমাদের পরে আসবে কঠিন ধৈর্য-পরীক্ষার যুগ। তখন ধৈর্যধারণ করাটা জ্বলন্ত অঙ্গার হাতের মুঠোয় রাখার মতো কঠিন হবে। সেই যুগে কেউ নেক আমল করলে তার সমকক্ষ পঞ্চাশ ব্যক্তির নেক আমল তাকে দেওয়া হবে।’[4]
****
দ্বীনের রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার দরুন নিজের পরিবার-পরিজন, সমাজ-রাষ্ট্রসহ সবার কাছে অপাঙক্তেয় হয় যারা, ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকেই বলা হয় গুরাবা।
গুরাবা একটি আরবী বহুবচন শব্দ। এর একবচন হলো গরিব। গরিব শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে :—বিদেশি, প্রবাসী, আগন্তুক, মুসাফির, অপরিচিত ইত্যাদি। গুরাবার পারিভাষিক অর্থের মধ্যে এর শাব্দিক অর্থের সবগুলোই পুরোপুরি বা আংশিক পাওয়া যায়। কারণ, দ্বীনের জন্য যিনি সমাজের লোকদের থেকে বিভিন্ন বিড়ম্বনার শিকার হন, তিনি তাদের থেকে দূরে সরে যান বা তারাই তার থেকে দূরে সরে যায়। ফলে ওই দ্বীনদার ব্যক্তি তাদের কাছে বহিরাগত কোনো অপরিচিত আগন্তুকের মতোই হয়ে যান।
দ্বীন পালনের অপরাধে (?) মানুষজনের কাছে অপাঙক্তেয় হয়ে ওঠার বিষয়টি অনেক ব্যাপক। যেহেতু দ্বীনের অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। ফলে গুরাবার পরিচয়টিও অনেক সম্প্রসারিত। কিন্তু অনেকে মনে করেন, গুরাবা বলতে বোঝানো হয় শুধু আল্লাহর পথে লড়াইকারী মুজাহিদকে—এটি সঠিক নয়; গুরাবার অর্থ এই এক শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যদিও একজন মুজাহিদ জিহাদের ফরয ইবাদত পালনের কারণে কিংবা একজন আলেম বা সাধারণ মুসলিম জিহাদের ভালোবাসা বুকে লালন করা ও জিহাদের বিস্মৃতপ্রায় আমলের কথা উম্মাহকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণে সমাজের লোকদের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে গুরাবার দলভুক্ত হয়ে উঠতে পারেন। অনেকে আবার মনে করেন, গুরাবা মানেই হলো যারা বন-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে কিংবা জনমানবশূন্য কোনো মরুভূমি বা নির্জন কোনো বিরান জায়গায় গিয়ে বসবাস করেন। দুনিয়ার লোকদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকীত্বের পথ ধরেন। এটিও গুরাবার সঠিক পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। কারণ, এভাবে ভেবে নিলে গুরাবার অর্থ সংকীর্ণ হয়ে যায়।
একজন মানুষ সমাজের লোকজনের সাথে বসবাস করেও গুরাবাদের দলভুক্ত হতে পারেন। লেখক উক্ত বইতে এক জায়গায় গুরাবার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে যে চিত্র এঁকেছেন, সেখান থেকেও আমরা প্রাথমিকভাবে গুরাবা সম্পর্কে একটি ধারণা অর্জন করতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘যখন একজন জ্ঞানী মুমিন—যাকে আল্লাহ তাআলা দ্বীনের বুঝ দিয়েছেন এবং নিজের দোষ-ত্রুটি দেখার সুযোগ দিয়েছেন ও তার সামনে মানুষের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেছেন, হক-বাতিল ও সুন্দর-অসুন্দরের মধ্যকার পার্থক্য করার শক্তি দিয়েছেন, সে সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ ও প্রবৃত্তিপূজারি এবং দুনিয়ার স্বার্থে পরকালের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনকারী ব্যক্তিদের সামনে সঠিক বিষয়ে আমল করাকে সে নিজের জন্য আবশ্যক করে নেবে; দুনিয়ার লোকেরা যখন দেখবে, কেউ তাদের কাজকর্মের বিপরীতে হাঁটছে, তখন সেটি তাদের জন্য কষ্টের কারণ হবে—ফলে তারা তার বিরোধিতায় উঠেপড়ে লাগবে, তার ছিদ্রান্বেষণে মত্ত হবে; সেই লোকের নিজের পরিবারের লোকেরাও তাকে নিয়ে চেঁচামেচি করবে, তার ভাই-বন্ধুরা তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত হবে; মানুষজন তার সাথে লেনদেন করতে আগ্রহবোধ করবে না; প্রবৃত্তিপূজারি ও অসৎ লোকজন তার বিরোধিতায় নিমগ্ন হবে; যেহেতু সে-সময় অধিকাংশ মানুষজনই ফিতনাগ্রস্ত ও গোমরাহিতে নিমজ্জিত হয়ে থাকবে, ফলে দ্বীন পালন করার স্বার্থে তাকে নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হবে; সমাজের বেশিরভাগ মানুষের জীবনাচার নষ্ট হয়ে যাবার কারণে লেনদেনের ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি একাকী হয়ে পড়বে; মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সঙ্গ বিনষ্ট হবার দরুন লোকদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করার ক্ষেত্রে সে অসহায়ত্বের শিকার হবে—মোটকথা ইহজাগতিক ও পরকালীন প্রতিটি বিষয়ে নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে যাবে; চলার পথে সে এমন কোনো সহমর্মীকে খুজে পাবে না, যে তার দুঃখ বুঝবে; এমন কোনো সহযোগীর দেখা পাবে না, যার কাছে গিয়ে প্রাণ শীতল করবে—এমন ব্যক্তিই হলো গুরাবাদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, সে হবে অসৎ লোকদের ভিড়ে সততা অবলম্বনকারী, অজ্ঞ লোকদের মাঝে জ্ঞানের ঝাণ্ডাধারী, মূর্খ লোকদের ভেতর সহিষ্ণুতা ধারণকারী; সে হবে দুঃখ-ভারাক্রান্ত—খুব কমই আনন্দ-ফুর্তিতে লিপ্ত; কেমন যেন সে কারাবন্দি কোনো কয়েদি—অত্যধিক ক্রন্দনে ডুবে-থাকা ব্যক্তি। সে হবে অপরিচিত সেই মুসাফিরের মতো, যাকে কেউ চেনে না; কেউ তাকে সহমর্মিতা জানাতে আসে না, অচেনা লোকে তাকে দেখে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।’
[1]. সূরা জিন : ৫৬
[2] . সূরা আল-ইমরান : ১৮৫
[3]. সূরা আনকাবুত : ২৯
[4]. আস-সুনান, ইবনু মাজাহ : ৪০১৪; আস-সুনান, তিরমীযী : ৩০৫৮। এর সনদে কিছুটা দুর্বলতা আছে। তবে ধৈর্য বিষয়ক অংশটি অন্য দুই হাদীসের সমর্থন থাকায় প্রামাণিকতার পর্যায়ে উন্নীত।