photo_2024-11-07 18.36.04

একজন হাফেজা ছাত্রীর সাক্ষাৎকার

ফাহমিদা জান্নাত তাসনিম। একজন সংসারী নারী। ঘরদোর আর পরিবার সামলে তিনি নূরুল কুরআন একাডেমিতে কিছুদিন পূর্বে পূর্ণ কুরআন হিফজ শেষ করেছেন। আমরা তার থেকে লিখিত একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তার হিফজের খুটিনাটি বিষয় জানতে চেয়েছি। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। 

আপনার হিফজ করার ইচ্ছাটা কবে এবং কীভাবে জাগ্রত হয়?

– আমার হিফজ করার ইচ্ছাটা জাগ্রত হয় প্রায় ৬ বছর আগে। কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই গভীর ভালোবাসা ছিল। তবে যখন দাওরাহ শেষ করি, তখন থেকেই কুরআন হিফজের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা জন্মায়। আমার হাদিসের শিক্ষক প্রথমে আমাকে কুরআন হিফজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং তার অনুপ্রেরণা আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। পরে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করার পর, আমার স্বামীও আমাকে মন-প্রাণ দিয়ে কুরআনের হাফিজা হতে উৎসাহিত করেন। তাদের এই সমর্থন ও প্রেরণার ফলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা কালাম হিফজ করার প্রতি আমার আগ্রহ আরও বেড়ে যায় এবং আমার হৃদয়ে আল্লাহর কালাম হিফজ করার ইচ্ছা আরও দৃঢ় হয়। সেই থেকে আমি এই পবিত্র কাজে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করি এবং নিয়মিত কুরআন হিফজের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি।

প্রথম হিফজ করা শুরু করেছেন অনলাইনে নাকি অফলাইনে? এবং কার কাছে?

– আমি প্রথমে নিজ উদ্যোগেই বাসায় কুরআন হিফজের যাত্রা শুরু করি। প্রতিদিন কিছু আয়াত বা রুকু মুখস্থ করার পর আমার স্বামীকে শুনিয়ে দিতাম। তিনি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং যদি কোনো ভুল করতাম, তা তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে দিতেন। তার এই সহযোগিতার মাধ্যমে হিফজের কাজটি শুরুতে বেশ সহজ ও উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই আমি আলহামদুলিল্লাহ প্রথম পারা সম্পূর্ণ মুখস্থ করতে সক্ষম হই এবং এতে ভীষণ অনুপ্রেরণা পাই। কুরআনের প্রতিটি আয়াত আমার হৃদয়ে আলোকিত হতে থাকে, এবং আমি অনুভব করি যে এটি আমার জীবনের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ।

তবে আমার স্বামীর পেশাগত ব্যস্ততায় নিয়মিত আমার সবক শুনতে পারছিলে না। তখন আমি উপলব্ধি করি যে একজন যোগ্য উস্তাজা বা একটি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধান ছাড়া এই মহান যাত্রা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আমার এই প্রয়োজন অনুভবের পর, আমার স্বামী অত্যন্ত আন্তরিকভাবে একটি ভালো প্রতিষ্ঠান খোঁজার জন্য চেষ্টা করেন। আলহামদুলিল্লাহ, তিনি নূরুল কুরআন একাডেমির সন্ধান পান এবং আমাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দেন।

নূরুল কুরআন একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আমার হিফজের যাত্রা নতুনভাবে শুরু হয়, এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি খুব সহজে কুরআন মুখস্থ করতে সক্ষম হই।

আপনি তো সংসারী নারী। সংসারের কাজকর্ম সামলে কীভাবে হিফজ চালু রেখেছিলেন? সমস্যা হয়নি কোন?

– হ্যাঁ, আমি একজন সংসারী নারী, তাই সংসারের দায়িত্বগুলো সামলে হিফজ চালিয়ে যাওয়া অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে আমি দিনে ছোট ছোট সময় বের করে নিয়মিত পড়তাম, যেমন সকালে রান্নার আগে বা রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে। মাঝে মাঝে অল্প সময় হলেও প্রতিদিন কুরআনের সঙ্গে সংযোগ রাখা আমার মূল কৌশল ছিল। সমস্যা ছিল, কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে ধৈর্য ধরে কাজ চালিয়ে গেছি। 

তাছাড়া হিফজের পুরো যাত্রায় আমার শাশুড়ি, ননদ এবং স্বামী অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। আমার শাশুড়ি সব সময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন এবং সংসারের অনেক কাজের দায়িত্ব নিজে তুলে নিয়েছেন, যাতে আমি মনোযোগ দিয়ে কুরআন মুখস্থ করতে পারি। পরবর্তীতে আমার জাও অনেক সাহায্য করেছেন। আমার ননদরাও সব সময় পাশে থেকেছেন, যখনই আমি হতাশ হতাম তারা আমাকে নতুন উদ্যমে শুরু করার প্রেরণা দিতেন। আর আমার স্বামী ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী । তিনি শুধু মানসিকভাবে নয়, সময়ের দিক থেকেও আমাকে সমর্থন করেছেন, যাতে আমি প্রতিদিন কুরআনের জন্য সময় বের করতে পারি। আল্লাহ তাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

হিফজ করতে গিয়ে মজার কোন ঘটনা কি ঘটেছে?

– হিফজের পুরো প্রক্রিয়ায় সহপাঠীদের সঙ্গে আমার খুব কম যোগাযোগ ছিল, ফলে কোনো উল্লেখযোগ্য মজার ঘটনা স্মৃতিতে নেই। অধিকাংশ সময়ই আমি একাকী অধ্যয়ন করেছি। সহপাঠীদের সঙ্গে সরাসরি মজার ঘটনা না ঘটলেও, এই যাত্রা আমার ব্যক্তিগত বিকাশের এক মজাদার দিক উন্মোচন করেছে।

নূরুল কুরআন একাডেমির সন্ধান কীভাবে পেয়েছিলেন?

– মূলত আমার স্বামী নূরুল কুরআন একাডেমির সন্ধান দেন এবং আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন। তিনি আমাকে একাডেমির অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে জানিয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমেই আমার নূরুল কুরআনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এরপর আমি সেখানে ভর্তি হয়ে আমার হিফজের পথচলা শুরু হয়।

কোন বিষয়টি আপনাকে হিফজ করতে সবচে বেশি সাহায্য করেছে বা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?

– আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছা। প্রতিদিন আল্লাহর কালাম মুখস্ত করার সময় আমি ভেবেছি, আমি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করছি। এছাড়া পরিবারের সাপোর্টও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমার  স্বামী সহ পরিবারের  সবার একচ্ছত্র সমর্থন ছাড়া এ মহৎ কাজ অনেক কষ্টসাধ্য ছিল।

হিফজ করতে গিয়ে কোন বিষয়টি আপনার কাছে সবচে চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে?

আমার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সংসার ও হিফজের মধ্যে ভারসাম্য রাখা। এছাড়া নিয়মিত পেছনের পড়া পুনরায় মুখস্থ রাখা ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কুরআনের হিফজ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, তাই ধৈর্য ও একাগ্রতার প্রয়োজন হয়, যা সবসময় সহজ ছিল না।

পেছনের পড়া মুখস্ত রাখার জন্য আপনি কী কী করতেন?

– পেছনের পড়া মুখস্থ রাখতে আমি প্রতিদিন অন্তত পিছনের পারাগুলো  থেকে রিভিশন করতাম। সকাল বেলা নতুন পড়া শুরু করার আগে, আগের পড়া কয়েকবার তিলাওয়াত করতাম। এছাড়া মাঝে মাঝে আমার স্বামীকে শুনাতাম, এতে আমি নিজেও নিশ্চিত হতে পারতাম যে আমার পড়া ঠিক আছে কি না।

কোনো সংসারী নারী হিফজ শুরু করতে চাইলে তার জন্য আপনার নসীহত/পরামর্শ কী থাকবে?

– আমি বলবো, ধৈর্য এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করা হিফজের প্রধান শর্ত। আপনি যত ব্যস্তই হন না কেন, প্রতিদিন আল্লাহর কালাম পড়ার জন্য সময় বের করতে হবে। ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রতিদিন এগিয়ে যেতে হবে। এবং অবশ্যই আল্লাহর উপর ভরসা রেখে কাজ করতে হবে।

পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করতে পেরে আপনার অনুভূতি কী?

– পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করতে পেরে আমি এক অনন্য অনুভূতির মধ্যে আছি। এটি এক আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ , এবং আমি প্রতিদিন তাঁর প্রতি শোকর আদায় করি। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি অসাধারণ মাধ্যম।

পরিশেষে, আমার উস্তাযা ফারিহা জান্নাত শুধু কুরআন হিফজের ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা পালন করেননি, বরং আমাকে ধৈর্য, শিষ্টাচার ও আদব শেখানোর মাধ্যমে চরিত্র গঠনেরও দীক্ষা দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, মার্জিত ও অসীম ধৈর্যশীলা, যা তার শিক্ষাদানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদেরকে শেখাতেন কীভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, অন্যের প্রতি সদাচরণ ও সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। উনার এই অমূল্য শিক্ষার ফলে কঠিন মুহূর্তগুলোতেও আমি দৃঢ় থাকতে পেরেছি। উস্তাজা হিসেবে তিনি কেবল জ্ঞানের আলো দান করেননি, বরং আমার জীবনের পথচলাকে আলোকিত করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা উনার এই অবদানকে কবুল করুন এবং উনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।

কষ্ট করে উত্তরগুলো দেবার জন্য আপনকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন৷ কুরআনের পাখি হয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবার তাওফীক দিন। আমীন।

যারা হিফজ করা শুরু করেছেন বা করবেন বলে ভাবছেন তারা চাইলে আমাদের প্রিরেকর্ডেড কোর্স ‘হিফজ নির্দেশিকা কোর্স’টি করে নিতে পারেন। এর মাধ্যমে আপনি কীভাবে সঠিক পন্থায় হিফজের পথে অগ্রসর হবেন সেই বিষয়ে একটি পরিষ্কার গাইডলাইন পপাবেন ইনশাআল্লাহ। কোর্সটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে

আমাদের একাডেমিতেও দীর্ঘ মেয়াদে হিফয করতে পরেন। আমাদের ‘হিফজুল কুরআন কোর্স’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে

আপনি চাইলে শুধু ৩০ নং পারাও (আম্মা পারা) হিফজ করতে পারেন। এর জন্য রয়েছে আমাদের ‘৩০ নং পারা হিফজ কোর্স’। এই কোর্স’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে

যেসব মাধ্যমে আমাদেরকে ফলো করে একাডেমির কার্যক্রম সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট পেতে পারেন – 

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn

জনপ্রিয় ব্লগ

কুরআন

আমার হিফজ-যাত্রা

শুরু করার আগে আল্লাহর দেওয়া তাওফীকে আলহামদুলিল্লাহ আমার হিফজের সবক শেষ হয়েছে। আল্লাহর অনেক শুকরিয়া আদায় করছি। পরিচিত অনেক আপুদের

পুরোটা পড়ুন