শব্দকে তার নিজস্ব অর্থে ব্যবহার না করে ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করা হলে বাড়তি মর্ম পাওয়া যায়। এটি ভাষার একটি স্বীকৃত বিষয়। শের বা বাঘ শব্দটি গঠিত হয়েছে বনের একটি জন্তুর নাম হিসেবে। বন্য সেই জন্তুকে বুঝানো হলো এর নিজস্ব অর্থ। কিন্তু যখন শব্দটি এই অর্থে ব্যবহার না হয়ে মানুষকে বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ‘শেরে বাংলা’ বা বাংলার বাঘ বলে, তখন বাড়তি যে মর্ম তাতে যোগ হয় তা হলো মানুষটির ভেতরে রয়েছে শক্তি ও সাহসিকতা।
আরবীভাষায় নাহনু (نحن) মানে আমরা। এটি দুইজন বা একাধিকজনের জন্য গঠিত একটি সর্বনাম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে একে নিজস্ব অর্থ থেকে সরিয়ে এক বচনের জন্য যখন ব্যবহার করা হয় তখন বাড়তি যে মর্ম তাতে স্থান করে নেয় তা হলো, ব্যক্তির মর্যাদাবান ও সম্মানিত হওয়া।
বিখ্যাত আরবী অভিধান ‘আল-মুজামুল ওয়াসীত’ এর লেখক বলেন, ‘সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বহু বচনের শব্দকে একজনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।’
সম্মানের প্রশ্নে আল্লাহ তাআলা হলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী। তিনি একক, লা শরীকা লাহু তথা অংশীদারবিহীন। কুরআনে অনেক আয়াতে তাঁর জন্য বহুবচনের শব্দ ব্যবহৃত হওয়ার একটি প্রধান কারণ এটি—সম্মান, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রদর্শন।
এখানে যে প্রশ্নটা থেকে যায় তা হলো, আল্লাহ তাআলা তো সবসময়ই ও সর্বক্ষেত্রেই সম্মানিত ও ক্ষমতার অধিকারী। কোন ক্ষুদ্রতম সময়ের জন্যও তাঁর মর্যাদা ও ক্ষমতা বিলুপ্ত হয় না, হবার মত নয়। তাহলে কেন কুরআনে সর্বদাই তাঁর জন্য আমরা বহুবচনের শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখি না? বরং কোথাও বহুবচন আর কোথাও একবচনের শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখি। যেখানে একবচনের শব্দ ব্যবহৃত হয় সেখানে কি তাঁর সম্মান-মর্যাদা ও প্রতিপত্তি থাকে না? কোথায় একবচনের শব্দ আর কোথায় বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা হয় আল্লাহর জন্য? এই লেখাতে আমরা জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব খোঁজার চেষ্টা করব ইনশাআল্ললাহ।
এই বিষয়টি বুঝার জন্য মোটাদাগে যেই মূলনীতি মাথায় রাখা যেতে পারে তা হলো, আল্লাহ তাআলা নিজের পরিচয় সংক্রান্ত আলোচনাতে সবসময় এক বচনের শব্দ ব্যবহার করেন। কেননা মূলত পরিচয়ের প্রশ্নে তিনি একক সত্তা। সেখানে কোন শরীক নেই। তাঁর কোন ছেলে-মেয়ে বা মা-বাবা নেই। তিনি যেমন কারো থেকে জন্ম নেননি, তেমনি কাউকে জন্মও দেননি। তাই এই ক্ষেত্রে একবচন উল্লেখ করাই যথার্থতার দাবি। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে,
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا
“নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই।”
পক্ষান্তরে যেখানে তিনি স্বীয় কর্মের কথা উল্লেখ করেন সেখানে সাধারণত বহুবচনের শব্দ উল্লেখ করেন। যেন তাঁর মর্যাদা, ক্ষমতা ও জালালত প্রকাশ পায়। যেমন-
وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا
“এবং আমরা (আমি) তোমাদের ওপর মজবুত সাতটি আসমান নির্মাণ করেছি।” (নাবা :১২)
মোটাদাগের কথাটি জানার পর এবার আমরা একে আরেকটু সবিস্তারে জানব।
মর্যাদা, সম্মান, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, বড়ত্ব, মহানুভবতা, দয়া, দান ইত্যাদি ক্ষেত্রে একবচন ও বহুবচন দুইটিই ব্যবহার করা হয়। কারণ এই কর্মগুলো দুই ধরনের-
১. যা সম্পাদনার ক্ষেত্রে আল্লাহই একমাত্র সত্তা। তিনি এটি নিজেই সম্পাদন করেন। এর সাথে অন্য কেউ সম্পৃক্ত হয় না। যেমন ক্ষমা করা, দুআ কবুল করা, অদৃশ্যের সংবাদ জানা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ জায়গায় একবচন ব্যবহার করা হয়।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ
“এবং নিশ্চয়ই আমি যারা তওবা করে তাদেরকে বারবার ক্ষমা করি।” (সূরা ত্বহা : ৮২)
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
“এবং তোমাদের রব বলেছেন, আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো।” (গফির: ৬০)
তবে এই জাতীয় কর্মের ক্ষেত্রেও মাহাত্ম্য-বড়ত্ত্ব ও মহানুভবতা বুঝানোর জন্য বহুবচনের শব্দ আসতে পারে; কিন্তু সেটা তুলনামূলক কম। যেমন-
فَاسْتَجَبْنا لَهُ وَوَهَبْنالَهُ يَحْيى وَأَصْلَحْنا لَهُ زَوْجَهُ
“অতপর আমরা (আমি) তাঁর দুআ কবুল করলাম, তাকে দান করলাম ইয়াহয়াকে এবং তাঁর স্ত্রীকে করে দিলাম সুস্থ।” (আম্বিয়া : ৯০)
২. যা মূলত আল্লাহ তাআলা সম্পাদন করলেও তিনি সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্য কাউকে দান করেন। তাঁর নির্দেশনা অনুপাতে তারা সেটি করে থাকে। কিংবা কোন বস্তুর মাধ্যমে তিনি কাজের বাস্তবায়ন ঘটান। এসব কাজের বাস্তব রূপায়নে অন্যদের অংশগ্রহণ থাকলেও মূল ভূমিকা আল্লাহরই এবং তাঁর নির্দেশনামা মেনেই অন্যরা সেগুলো পালন করে। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ জায়গায় বহুবচন ব্যবহার করা হয়।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
“নিশ্চয়ই আমরা (আমি) কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই (আমিই) তাকে হিফাজত করব।” (সূরা হিজর : ০৯)
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ
“এবং আমরা (আমি) আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি। আমরা (আমি) তাদেরকে বাহন দিয়েছি জলে ও স্থলে…। (ইসরা :৭০)
وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا
“এবং আমরা (আমি) আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি।” (ফুরকান:৪৯)
তবে এই জাতীয় কর্ম যেহেতু মূলত আল্লাহই ঘটান সেটা বুঝানোর জন্য একবচনের শব্দেও আসতে পারে; কিন্তু সেটা তুলনামূলক কম। যেমন-
ذَرْنِي وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيدًا
“আমাকে ও আমি এককভাবে যা সৃষ্টি করেছি তাকে ছেড়ে দাও। (সূরা মুদ্দাসসির : ১১)
আল্লাহর পরিচয়, ইবাদাতের নির্দেশনা, তাওহীদ সাব্যস্ত করা, শিরককে নাকচ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সর্বদা একবচনের শব্দ ব্যবহৃত হয়। কারণ এই বিষয়গুলোর এটিই যথার্থ দাবি। যেমন-
لاَ تُشْرِكْ بِي شَيْئاً
“তোমরা আমার সাথে কাউকে শরীক করো না।” (সূরা হজ : ২৬ )
ومَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالإِنْسَ إِلاَ لِيَعْبُدُونِ
“এবং আমি মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদাত করার জন্য।” (যারিয়াত : ৫৬)
وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ
“এবং আমি তোমাদের রব। অতএব তোমরা আমার ইবাদাত করো।” (আম্বিয়া : ৯২)
তবে একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে। তা হলো, বিভিন্ন উপযোগিতার বিবেচনায় যদিও নানান আয়াতে আল্লাহর জন্য বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এর আগে-পরে সাধারণত এমন কোন কিছু থাকে, যা আল্লাহর একক হওয়ার প্রমাণ বহন করে। যেমন সূরা কাউসারে আল্লাহ তাআলা বলছেন-
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
“নিশ্চয়ই আমরা (আমি) আপনাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং আপনি আপনার রবের জন্য সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন।” (কাউসার: ১-২)
এই আয়াতে প্রথমে বহুবচনে দান করার কথা বলা হলেও পরক্ষণেই এক বচনে ‘রব’ শব্দ আনা হয়েছে। যার দ্বারা আগের আয়াতে আলোচিত দাতাকেই উদ্দেশ্য নেওয়া হচ্ছে। ফলে আর কোন সংশয় থাকে না যে, উক্ত দাতা একক সত্তা, একাধিকজন নন।
এমনই আরেকটি উদাহরণ সূরা ফাতহের এই আয়াত থেকেও দেখা যেতে পারে-
إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحاً مُّبِيناً لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطاً مُّسْتَقِيماً
“নিশ্চয়ই আমরা (আমি) আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি, যেন আল্লাহ আপনার আগে-পরের সকল পাপ মাফ করে দেন এবং আপনার ওপর তাঁর নিয়ামতকে পূর্ণ করেন ও আপনাকে সঠিক পথ দেখান।” (সূরা ফাতহ : ১-২)