এসএসসি পরীক্ষার পরে আরবী ভাষা শেখার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম পরিণত বয়সে এসে তা পূরণ হলো। যৌবনে কত ছাইপাশ বই পড়ে সময় নষ্ট করেছি তার জন্য আক্ষেপ হলেও আমার মালিক যে এই বয়সেও আমাকে দিয়ে এসো আরবী শিখি বইটা শেষ করিয়েছেন এবং আরবী ভাষা কিছুটা হলেও বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন তার জন্য কোটি কোটি শুকরিয়া। আমার মালিক যেন এই ইলেম অর্জনকে কবুল করে নেন।
এই কথাটুকু পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে, আমাকে আমার রব এই নেয়ামত দিয়েছেন বলে আমি পেরেছি। তাকে দেন নাই তাই সে পারছে না। এক্ষেত্রে আমি নিজের কিছু কথা তুলে ধরছি।
বিদেশের মাটিতে তিন সন্তানের সংসার আমার। বাসায় কোন সাহায্যকারী নেই। তাছাড়া প্রায়ই দেশ থেকে আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসতেন আলহামদুলিল্লাহ। কোন অবস্থাতেই আমি পড়াশোনাতে ছাড় দেইনি। আবার সংসারেও অবহেলা করিনি। নিজের সবটুকু বিলিয়ে সবকিছু সামলে নেবার চেষ্টা করেছি। হয়ত খাবারে একটা আইটেম কম ছিল; কিন্তু সময়মত সবার খাবারটা ঠিকই রেডি করে দিয়েছি। সহীহ নিয়ত, সদিচ্ছা আর ক্রমাগত চেষ্টা-প্রচেষ্টার কারণেই আমার রব আমাকে এই প্রতিদান দিয়েছেন। সকল শুকরিয়া কেবল তাঁরই—আলহামদুলিল্লাহ।
এই লেখনীতে আমার স্বামীর নাম না বললেই নয়। তিনি সবদিক থেকে সাহায্য না করলে হয়ত এই পথ চলা এত সহজ হতো না।
যাদের হাত ধরে আমার এই অর্জন তাদের শুরুতেই আসে শ্রদ্ধেয় উস্তায আবদুল্লাহ আল মাসউদ এর নাম। আমার মালিক যেন উনার কাজকে কবুল করেন। আরবীভাষা শেখার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরে অবশেষে এখানে এসে পড়তে গিয়ে অনেক শান্তি পেয়েছি। তিনি বহু কষ্ট করে নোটসহ সব কিছু তৈরী করে পড়াটাকে আমাদের কাছে অনেক অনেক সহজবোধ্য করে দিয়েছেন। অনুশীলন করা এবং আমাদের উৎসাহিত করার জন্য বার বার মজলিশের আলোচনার মাধ্যমে নিজে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছেন। উনার ঋণ শোধ করার মত না। আল্লাহ তাআলা যেন ওনার নুরুল কোরআন একাডেমিকে আরো অনেক বড় প্রতিষ্ঠান হিসাবে কবুল করেন। আমিন।
সবচেয়ে আরামবোধ করেছি ছেলে-মেয়ের আলাদা পড়ার ব্যবস্থাটাতে। আমাদের সহকারী উস্তাযাহ মুসলিমা আপুর সহযোগিতা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। তাঁকে বহুদিন পড়া শুনানোর জন্য বসিয়ে রেখেছিলাম। অনেক সময় সময়মত পড়া দেইনি। এখন না তখন দিব করে জ্বালিয়েছি। তারপরেও তিনি এতটুকুও রাগ করেননি। এতগুলো ছাত্রীর আবদার হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। এসবের প্রতিদান যেন আল্লাহ্ তাকে দান করেন।
নতুনদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, কোন কাজে লেগে থাকার বিকল্প কিছু নাই। আমার গাফিলতির জন্য আমি এখনো হয়ত খুব ভালভাবে রপ্ত করতে পারিনি। তারপরেও যতটুকু এখন বুঝতে পারছি এই লেগে থাকার জন্যই। শয়তান যে কতবার চেষ্টা করেছে হতাশার সৃষ্টি করতে তার কোন ইয়ত্তা নেই। একেকবার একেক ঢঙের কথা নিয়ে হাজির হয়েছিল—এতদিন পড়ছ তাও তো কিছুই জানো না… থাক আর সম্ভব না, ছেড়ে দাও… পড়া জমে আছে, আর পারবে না… অন্য ইবাদত করো, এটা হবে না… ইত্যাদি। কত কথা যে মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলত আজ সব মনেও নেই।
আমার পরামর্শ হলো, সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে শুধু প্রতিদিনের দারসটা শুনেন আর শব্দার্থগুলো মুখস্ত করেন। তারপর ব্যাকরণটা বোঝার চেষ্টা করেন। কোনভাবেই দারস দেখাটা যেন জমে না যায় এটার উপর সবচে জোর দিবেন। ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই।
যারা শুরু করতে ভয় পাচ্ছেন তাদের বলব, আমরা মানুষরা কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকি। শয়তান চাইবেই আমরা যেন এমন কাজে ব্যস্ত থাকি, যাতে সোওয়াবের পরিমাণ একদমই নেই বা খুবই নগণ্য। সংসার করাটা আমাদের জন্য ইবাদত; কিন্তু এই ইবাদতের কাজটা করতে গিয়ে অনর্থক অনেক কিছুতেই অতিরিক্ত সময় অপচয় করে ফেলি। তাই যতটুকু প্রয়োজন বা যা না হলেই না তা করার পর ফরজ ইবাদতের পর কোরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফায়দা বিশাল। এই নিয়তে কেউ ভাষা শিখতে পারেন, হেফজ করতে পারেন বা যে কোন দ্বীনি বিষয়ে চর্চা করে ত্বলিবুল ইলমের খাতায় নিজের নামটা লেখাতে পারেন। কারণ হাদীসে এসেছে,
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنّةِ.
‘যেই ব্যক্তি ইলম তলবের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করবে আল্লাহ পাক এর বদৌলতে তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেবেন।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯)
অন্য হাদীসে এসেছে,
مَنْ خَرَجَ فِي طَلَبِ العِلْمِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ حَتَّى يَرْجِعَ.
‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য বের হল সে আল্লাহর রাস্তায় বের হল।’ (জামে তিরিমিযী, হাদীস ২৬৪৭)
আরেকটা উপকারী এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক আমি খুঁজে পেয়েছি। তা হলো, শেষ বয়সে আমরা আমাদের সংসারের মায়া ছাড়তে পারিনা। এতে দেখা যায় হিতে বিপরীত হয়। সন্তানদের সাথে মনোমালিন্য হয়। ইবাদতে গাফলতি হয়। তাই সংসার করার ভেতর দিয়েই সংসারের মায়া ছেড়ে ইলম অর্জনে ব্যস্ত থাকার বদৌলতে দেখা যাবে আল্লাহ তাআলা আমাদের জাগতিক সমস্যার সমাধান করে দিবেন আর আমাদের মৃত্যুটাও ইলম ইর্জনের মধ্য দিয়েই হবে ইনশাআল্লাহ।
যাইহোক, গত ২৬শে জুলাই ২০২২ উস্তায আবদুল্লাহ আল মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ যখন সমাপনী দারসের পোষ্ট দিলেন, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে, সমাপনী ব্যাচে আমিও অন্তর্ভুক্ত আছি। আমার মালিক আমাকে এত বিশাল নেয়ামত দিয়েছেন, এ যেন রীতিমত স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।
পরিশেষে বলব, আমি আমার সন্তানদেরও এই পথের পথিক করতে চাই। কুরআনের ভাষার সাথে তাদের পরিচয় করাতে চাই। নুরুল কোরআন একাডেমিকে আল্লাহ্ তাআলা কবুল করুন। আগামীর পথচলাকে সুগম করুন। যাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম; বিশেষকরে মেয়েদের ইলম অর্জন আরও সহজ হয়। দুনিয়া যেন দ্বীনি আলোয় আলোকিত হয়। আল্লাহুম্মা আমীন।