শুরু করার আগে
আল্লাহর দেওয়া তাওফীকে আলহামদুলিল্লাহ আমার হিফজের সবক শেষ হয়েছে। আল্লাহর অনেক শুকরিয়া আদায় করছি। পরিচিত অনেক আপুদের খুব ইচ্ছা ছিল আমার হিফজ-জার্নি শুনবেন। যেদিন তারা আমাকে ধরে বসলেন, সেদিন তাদেরকে বললাম, এই বরকতময় বিষয়টা নিয়ে আমি লিখবো ইনশাআল্লাহ। পরবর্তীতে ছোট করে একটি অনুভূতি লিখি। বিস্তারিত লেখার সাহস হচ্ছিল না যে, এতো মুবারক সফরে যা কিছু পেয়েছি সব তো আল্লাহই তার আপন দয়ায় দিয়েছেন। এগুলো ব্যক্ত করার মতো অনুভবশক্তিও আমার নেই; নেই বলার মতো আদবও। শুরুতেই ছোট করে লিখেছিলাম। লেখাটি দেখে আমার উস্তায আবদুল্লাহ আল মাসউদ সাহেব আরও সুন্দর করে কিছুটা বিস্তারিত আকারে লিখতে বললেন। তাঁর কথার কারণেই বর্তমান লেখাটা লিখতে বসি। বাস্তবতা হলো হিফজের পথের এই লম্বা জার্নি বলে কিংবা লিখে সবটুকু প্রকাশ করার মত যোগ্যতা আমার নেই, পাঠক সেটা মাথায় রাখবেন। অসংখ্য অগণিত গোনাহের বোঝা কাঁধে নিয়ে কুরআন হিফজের যোগ্যতা যে আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, সেটাই তো অনেক। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই, তিনি যেন তাঁর বান্দার প্রতি অসন্তুষ্ট না হোন। আমার লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য অন্যদেরকে হিফজের প্রতি আগ্রহী করা।
হিফজের প্রতি যেভাবে আগ্রহ জন্মাল
আল্লাহর কালাম হিফজ করার ইচ্ছাটা যেভাবে আমার মনের মধ্যে শেকড় গেড়েছিল সেই গল্পটা বলতে গেলে জীবনের শুরুর দিকে যেতে হবে। কুরআনের সাথে আমার পথচলার শুরুটা হয় আম্মুর হাত ধরে। ছোটবেলায় মাগরিবের পর আম্মুর সাথে কুরআন পড়তাম, এভাবেই একবারে ছোট বয়সে ঘরে বসে সূরা যিলযাল পর্যন্ত মুখস্থ করেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। এরপর শুরু হয়েছিল মক্তব-যাত্রা। ছোটদের মক্তবের সে ধারা আজ বিলুপ্তির পথে। সাথে আমাদের ছোটরা বঞ্চিত ভোরের বারাকাহ থেকেও। মক্তবে কুরআনে কারীম কয়েকবার পড়ে খতম করার পর হুজুর কিছু আমলী সূরা মুখস্থ করিয়েছিলেন। এতটুকু মুখস্থ দিয়েই চলছিল আমার জীবন। তারপর নিজের অন্যান্য পড়াশোনায় মশগুল হয়ে যাই। ফলে হিফজের দিকে আর তেমন মনোযোগ দিতে পারিনি। বাসায় ইসলামের ইতিহাস, সাহাবাদের জীবনী পড়তাম। সাহাবায়ে কেরামের (রিদ্বওয়ানুল্লাহি আজমাঈন) জীবনীতে কিয়ামুল লাইলে পূর্ণ কুরআনুল কারীম খতম, সূরা বাকারা খতম করা দেখে অবাক হতাম। কিছু একটা ভেতরে ভেতরে গুমরে মরতো। কিন্তু সেটা কী তা পুরোপুরি ধরতে পারতাম না। আসলে আল্লাহ তৌফিক দিলে আমিও পূর্ণ কুরআনের হাফেজা হতে পারব- এই ভাবনাটা হৃদয়পটে কখনো উদিত হয়নি।
ইসলামিক বিভিন্ন কিতাব পাঠ মানুষের জীবনে অনেক কিছু এনে দেয়; এমনকি জীবনের মোড় পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে বদলে দেয় কখনও কখনও। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তাই অনেক বই পড়তাম আলহামদুলিল্লাহ। হিফজের স্বপ্ন প্রথম আমার দিলে একটু আসন গাড়লো একটি বইয়ের পাঠ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া থেকে। বইটির নাম ছিল ‘আমার আম্মা’। লেখক আবুল হাসান আলী নদভী (রাহিমাহুল্লাহু)। এই বইতে তিনি তাঁর সম্মানিত আম্মার জীবনের কিছু কথা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর আম্মার হিফজের জার্নিটা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ছিলেন তাঁর বংশে সর্ব প্রথম কুরআনের হাফেজা। মোটামুটি একটা বাঁধা পেরিয়ে তিনি এই স্বপ্নের পূর্ণতা পেয়েছিলেন এবং তাঁর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও অনেকে হিফজের যাত্রা শুরু করেছিল। তখন আমারও ইচ্ছে হলো অবসর সময় কুরআন হিফজের পেছনে ব্যয় করতে। আব্বু-আম্মু মনে করতেন মেয়েদের জন্য হিফজ তো কঠিন যাত্রা, তাই তাদের তেমন আশা বা ইচ্ছা ছিলো না।
আমি নিজ আগ্রহে হিফজ করা শুরু করি। ঘরে বসে এক পারা মুখস্ত করেছিলাম। এরপর একটা সময় হিফজ করা থেমে গিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে হাফেজা হওয়ার স্বপ্নটা তখন জ্বলে আর নিভে। পরবর্তীতে যখন শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহিমাহুল্লাহ এর আত্নজীবনী ‘আপবীতী’ পড়তাম, তাঁর খান্দানের নারীদের হিফজের আলোচনাগুলো আমাকে অনেক উদ্বুদ্ধ করতো। ভেতরে একটা তড়প নিয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম, তাঁরা এবং আবুল হাসান আলী নাদবী রাহ এর আম্মাজান মুহতারামা খাইরুন্নেসা (রাহিমাহাল্লাহ) এর জীবন তো নিকট অতীতে। আর আল্লাহ চাইলে বিষয়টা অসম্ভব কিছুও না।
এরপর দ্বিতীয় বার আবার হিফজ করার প্রতি আমার প্রবল ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছিলো মসজিদে নববীতে কুরআনের হালাকায় ছোট ছোট বাচ্চাদের নিমগ্নতা দেখে। যে ক’দিন আল্লাহ মদীনার বাতাসে শ্বাস নেবার তাওফীক দিয়েছিলেন খুঁজে খুঁজে তাদের আশেপাশে বসে থাকতাম। নিজের ইচ্ছার পরও যা এখনও আমার তাওফীকে আসেনি তা অন্যের মাঝে দেখার মধ্যে এক ধরণের বেদনামিশ্রিত অনুভূতি আছে, যা অন্তরের সুপ্ত ইচ্ছাটাকে জিইয়ে রাখে। মসজিদে নববীর সুবিশাল শামিয়ানার নিচে বসে তাঁদের দিকে নিরবে চেয়ে থাকতাম । নিজেকে শুণ্য মনে হতো।
সে বছরই অনলাইনে এসেছিলাম অবসর সময়ে আরবীর দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে নিতে। এখানে এসে সাওদা নামে এক আপুকে পাই। তিনি কুরআনে কারীমের হাফেজা এটা বুঝতে পেরেছিলাম। ভার্সিটিতে পড়েও পরবর্তীতে তিনি হাফেজা হয়েছেন। আপুর হিফজের গল্প শুনে আম্মু-আব্বুকে জোর করে ধরলাম যে, জেনারেল লাইন থেকে এসে বড় হয়ে হিফজের তাওফীক আল্লাহ দিয়েছেন, এমন উদাহরণ তো আছে। আল্লাহ চাইলে যাকে ইচ্ছা যখন ইচ্ছা দেন, শুধু চাইতে হয় কাতর হয়ে শূণ্য হাত দুখানি পেতে। এরপর কুড়িয়ে নিতে হয় নত মস্তকে সমর্পিত হৃদয়ে। অনেক মিনতির পরে আব্বু-আম্মু পাঁচ পারা হিফজের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। একটি একাডেমিতে পাঁচ পারা হিফজের কোর্স ছিল। পরে কোন এক কারণে সেখানে হয়নি দেখে সাওদা আপু পার্সোনালি একজন উস্তাযার খবর দিয়েছিলেন। এটা আমার জন্য খাইরই ছিল আলহামদুলিল্লাহ। নয়ত এই পাঁচেই হয়তো সীমাবদ্ধ হয়ে যেতাম আমি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই।
আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু
আল্লাহর রহমে কোন উস্তাযার অধীনে থেকে হিফজের সবক শুরু হলো খুলনার উস্তাযার কাছে চৌদ্দশো বিয়াল্লিশ হিজরী রজব মাসের এগারোতম দিনে। আগে যে এক পারা হিফজ করেছিলাম এতো দিনে সেটা স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এরপর ঐ মাসেই আল্লাহর রহমতে সেই বিস্মৃত পারাসহ দু’ পারা হিফজের তাওফীক পেয়ে গেলাম আলহামদুলিল্লাহ। ২০২০ সালে করোনার জন্য লকডআউন শুরু হয়ে গেলে শাবান মাস গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। ওখানে নেটওয়ার্ক সমস্যা এবং রুটিনে ব্যাঘাত ঘটায় সবক শুনানো বন্ধ হয়ে গেল। তখন হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রাহিমাহুল্লাহ) এর একটা কথা মনে হতো খুব। কথার সারমর্ম এরকম ছিল, ঘন ঘন বেড়ানোতে নিয়মের ব্যাঘাত ঘটে। আমার বেলাতেও সেটাই যেন বাস্তব হলো।
সে বছরের রমাদানের চাঁদ দেখা দিলে আমরা গ্রাম থেকে বাসায় ফিরলাম। তখন থেকে আবার হিফজ করা শুরু হলো আলহামদুলিল্লাহ। রমাদান শেষ হবার একটু আগে সূরা আলে ইমরান শেষ হলো। অসুস্থতার কারণে কিছুদিন পড়া বন্ধ ছিল। উস্তাযা বললেন, রমাদানে নিয়ম বদলে যাওয়ায় এরকম অসুস্থতা হচ্ছে আপনার। ইনশাআল্লাহ রমাদানের পরে সুস্থ হয়ে যাবেন, তখন পারবেন। রমাদানের পর ঈদের জন্য গ্রামের বাড়ি যাই। গ্রামের বাড়ি যাওয়া মানে এমনিতেই সবক বন্ধ থাকা। তার উপর অসুস্থতাও তখনও কাটেনি। তাই আরো কিছু দিন থমকে ছিল আমার হাফেজা হওয়ার স্বপ্নযাত্রা।
উদ্যমতা হারিয়ে যাওয়া হিফজের পথে বেশ আশংকার বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহ না করুন, উদ্যমতা হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সবকে অনিয়মিত হওয়াই যথেষ্ট। এজন্য উস্তায আবদুল্লাহ আল মাসউদ সাহেব আমাদের অনেক সময় তরবিয়তি মজলিসে বলেন- আমরা যেন প্রতিদিন উস্তাযাকে পড়া শুনাই। একেবারে অল্প পরিমাণে হলেও। যদি কোনদিন মাত্র এক আয়াত মুখস্ত হয়, তবে সেটাই যেন শুনাই। আর যেদিন একটুও নতুন পড়া মুখস্ত করা সম্ভব হবে না, সেদিন উস্তাযার সাথে অন্তত সালাম বিনিময় করে নিতে। যাতে করে নিয়মতান্ত্রিকতা ছুটে না যায়। ছাত্রীদের উৎসাহিত করতে এক্ষেত্রে উস্তায বড়দের অনেক উদাহরণও দেন তাদের জীবন থেকে। উস্তাযের মজলিসগুলো একাডেমির ওয়েবসাইটে কিংবা ইউটিউব চ্যানেলে খোঁজ করলেই মিলবে ইনশাআল্লাহ। (মজলিসগুলো দেখতে ক্লিক করুন এখানে) সেখানে একটা ভিডিও আছে, যারা হিফজ শুরু করবেন ভাবছেন বা হিফজের রুটিন কেমন হবে খোঁজ করছেন তাঁদের জন্য দিক নির্দেশনা স্বরূপ। এটা খুবই উপকারী। আমার হিফজের জার্নি শুরু হবার কিছুদিন পর এটা পাবলিশড হয়েছিল। আমি এখনো মাঝে মাঝে এটা শুনি এবং হিফজে আগ্রহী ভাইবোনদের দেই। পাশাপাশি মুফতি মুশতাকুন নবী হাফিযাহুল্লাহর একটা আলোচনা আমাকে কুরআনের আযমত সম্পর্কে গভীর একটা বোধ দিয়েছিল আলহামদুলিল্লাহ। অসুস্থতা এবং অনিয়মের সাথী হয়ে কিছু হাঁটা কিছু থেমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পাঁচ পারা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলাম। এরপর আমার ভাইকে করোনার থাবা অসুস্থ করে দিল। জীবন মরণ লড়াই যেন। পুরো পরিবার তখন পেরেশান। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।। আমার পড়াশোনাটাও থমকে গেল। সেসময় হতাশার সাগরে হাবুডুবু খেতাম। একদিন উস্তাযাকে মেসেজ দিয়েছিলাম যে আবার পড়বো ইনশাআল্লাহ। ছয় নং পারা শেষ হতে হতে আবার অনিয়ম, বিভিন্ন বাঁধা-বিপত্তি এসে উপস্থিত। এক পর্যায়ে আবার পড়া বন্ধ হলো।
নুরুল কুরআন একাডেমিতে ভর্তি
এই ঝড়-ঝাপটার ভেতর দিয়েই আমি একটু একটু করে আগাচ্ছিলাম। তখন নুরুল কুরআন একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়েছে মাত্র। আরবিভাষা দিয়ে শুরু হলেও কিছুদিন পর হিফজ বিভাগও চালু করা হয়। আমি ভাবলাম, এখানে যদি একাডেমিক নিয়ম-শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতার ভেতর দিয়ে পড়া শুরু করি, তাহলে হয়তো গাফলতির সুযোগ পাবো না। সাওদা আপু এবং সাহিদা আপুর সাথে পরামর্শ করে আবার নতুন যাত্রা শুরু হলো। সকাল আটটা থেকে এগারো টার ব্যাচে একজন উস্তাযার কাছে। আমি প্রথম থেকে ছয়পারা হিফজ করেছিলাম আগে। এখানে এসে ছাব্বিশ নং পারা থেকে শুরু করলাম। এরপর সাত থেকে শুরু করেছিলাম আবার আলহামদুলিল্লাহ। এক পৃষ্ঠা সবক, সাতসবক শুরুতে দিতাম। সহপাঠী একজন আপুকে আমুখতা শুনানো হতো সময়ের অভাবে। হাতে গোনা কিছু দিন যাবার পর উস্তায একবার খবর নেবার পর চালু হলো উস্তাযাকে আমুখতা শুনানো। যতটুকু হয় ততটুকু থেকে কিছু প্রশ্নত্তর। পাশাপাশি সহপাঠী আপুকেও শুনাতাম। উস্তাযের এই পরামর্শগুলো হিফজের অনেক কঠিন সময়ে সঠিক পথ দেখাতো আলহামদুলিল্লাহ। সাথে সুইট হার্ট কুরআন কিতাব এবং তার লেখকের হিফজ বিষয়ক আলোচনা, উইথ দি কুরআন পেইজ এরকম কুরআনুল কারীম হিফজ বিষয়ক নানা আলোচনা, বয়ান, কিতাব, আর্টিকেল খোঁজ করে পড়তাম এবং এগুলো থেকে অনেক অনেকভাবে উপকৃত হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। এভাবেই একটু একটু করে হাফেজা হওয়ার স্বপ্নের চারাটি পরম যত্নে বড় হতে থাকে।
আল্লাহর রহম ও ফযলে এভাবেই ছুটতে থাকি কুরআনের পথের যাত্রী হয়ে। চলতে চলতে কোথাও থমকে যাওয়া, কোথাও আটকে যাওয়ার সময়ও পার করেছি। এমন অনেক কঠিন সময়ও পার হয়েছে যেটা বলার বাইরে। সেগুলো থেকেও আল্লাহ দয়া করে মুক্তি দিয়েছেন এবং সহজ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। সাওদা আপু এবং সাহিদা আপুকে পাশে পেয়েছি অনেক সময় (আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর শান অনুযায়ী বদলা দান করুন আমীন)। সাহস দেবার মত মানুষ সে তুলনায় খুব কমই ছিল। তবুও আল্লাহ আমার সহায় হয়েছেন বলে সহজ হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। না হয় আমার কী-ই বা যোগ্যতা আছে? যা আছে তাতে সব হারানোরই কথা ছিল। কিভাবে যেন টিকেছি শত কদর্যতা মাখা এই আমি, জানি না। শুধু জানি আমার মালিক বড়ই দয়ালু ও মেহেরবান। তিনি শত অযোগ্যতা ও গুনাহের পরেও বান্দাকে সুযোগ দেন।
স্বপ্ন পূরণের সন্ধিক্ষণে
আল্লাহর অপার করুণায় শেষ বছরে আমি বেশি বারাকাহর দেখা পেয়েছি এবং নিজের ভেতরের টানাপোড়েন থেকেও মুক্তি পেয়েছি। ৪৩ হিজরীর রমাদানে আমার সবক হয়েছিল আঠারো পারা, এর মধ্যে ছয় থেকে এগারো পারা ছিল নতুন পড়া। ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য গ্রুপ পাল্টে এসেছিলাম অন্য আরেক উস্তাযার কাছে। এই ব্যাচে ফজরের পর পরই পড়া শুনানো লাগত। এ বছর শুরু থেকেই পরিকল্পনা ছিল আল্লাহ চাইলে আগামী রমাদানের আগে আমি সবক শেষ করবো। সেজন্য নিয়ত করেছিলাম একদিনে দুই তিন পেইজ করে সবক দিবো, আর অন্য দিন পেছন থেকে পড়া দিব। অর্থাৎ, সপ্তাহে তিনদিন নতুন সবক, দুদিন পেছনের কাঁচা পারা আড় একদিন সবিনা। সেসময় বারো বছরের ছোট্ট মুহসিনার সাথে আমুখতা শুনানো হতো, সাথে মাঝে মধ্যে আগের সহপাঠী ফাহমিদা আপুও থাকতেন। (এ লেখাটা যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখন তাদের উভয়েরই হিফজ শেষ হয়েছে নুরুল কুরআন একাডেমি থেকে আলহামদুলিল্লাহ। )
নানা রকম ত্রুটি-বিচ্যুতির সাথে আমার হিফজ এগিয়ে যেতে থাকল। কখনো নিয়মিত কখনো ব্যস্ততার কারণে অনিয়মিত। এভাবেই যখন জুমাদাস সানী মাসের চাঁদ আকাশে উদিত হলো, আমার দিন আর পেইজ গুণা শুরু হয়ে গেলো। পাঁচ পারা থেকে কিছু কম বাকি আছে তখন। এদিকে রমাদান আসতে বাকি মাত্র তিন মাস। এই পর্যায়ে এসে আব্বু-আম্মুও আমাকে উৎসাহ দিলেন। সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করলেন। দ্বিগুণ উৎসাহে আমি অনেক দিন পাঁচ পেইজ করেও সবক দেওয়ার তাওফীক পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। শেষ দিকে শুধু কুরআন নিয়েই পড়ে থাকতাম।
যখন শাবান মাস আসলো, আমার পেরেশানিও বেড়ে গেল। শুধু মনে হচ্ছিল, আর কয়েকটা দিন যদি হায়াত না পাই? হিফজের এই সফর শেষ হওয়ার আগেই যদি পরকালে যাওয়ার ডাক এসে যায়? যদি আল্লাহ অগুনিত গোনাহের জন্য হিফজ শেষ করার সৌভাগ্য থেকে মাহরুম করেন? এভাবে নানান দুশ্চিন্তা আডর ভয়-আশঙ্কার ভেতর দিয়েই অবশেষে শেষ সবক শুনানোর দিনটা সমাগত হলো।
শেষ সবকের আগের দিন যখন আমার চাচা-মামা, ফুফু-খালা-আত্নীয়দের কাছে ফোনে দুআ চাচ্ছিলাম, তখন থেকেই বারবার চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ফোটা বেয়ে বেয়ে পড়ছিল। আমার আনন্দকে কয়েকগুণ বাড়িয়েছিল যে বিষয়টি তা হলো, যেদিন আমি হিফজের শেষ সবক শুনাই সেদিন ছিল ৪৪ হিজরীর ১৫ শাবান- শবে বরাত। মাগরিবের পর জুমে সব সহপাঠী আপুরা ও বাহির থেকে আরও অনেক আপুরা অংশগ্রহণ করলেন। সবার সেকি উচ্ছাস! আর এদিকে আমার পুরো পরিবার, আত্মীয়-স্বজন হোয়াটসঅ্যাপে এক্টিভ হয়েছে ত্রিশজনের মতো আব্বু, আম্মু ও ভাইয়ের ফোনে। আমি দিনের বেলায় বাসায় আম্মু ও আপুর কাছে পড়া শুনিয়ে মাগরিবের পর সাওদা আপু এবং সাহিদা আপুর কাছে পড়াটা আবার শুনিয়ে নিলাম। যেন সবার সামনে শেষ সবক তিলাওয়াত করতে গিয়ে কোন অসুবিধায় পড়তে না হয়। তবুও নার্ভাসনেস আর অতি খুশি ও আনন্দের প্রাপ্তিতে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। শবে বরাতের ফজিলতপূর্ণ রাতে একাডেমির সকল উস্তাযা ও অন্যান্য তালিবাহদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়ে ইশার সময় ভাঙা ভাঙা গলায় কান্না বিজড়িত কণ্ঠে শেষ সবক শুনাই আমি। এখনও লিখেতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। স্মৃতিতে ভেসে উঠছে সেদিনের সব দৃশ্য। অনুষ্ঠান শেষে ছিল উস্তাযাদের নসিহত ও আন্তরিক দুআ। নুরুল কুরআন একাডেমিতে এটাই ছিল কোন ছাত্রীর প্রথম হিফজ শেষ করার ঘটনা। তাই আয়োজনটাও ছিল সুন্দর ও গোছানো। সব মিলিয়ে আমার হিফজ শেষ করতে সময় লেগেছিল তিন বছরের মত। এর মধ্যে নুরুল কুরআন একাডেমিতে পড়েছি দুই বছর দুই মাস।
হিফজের এই জার্নিতে কৃতজ্ঞতা জানাই আমার আব্বু-আম্মু, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, সাওদা আপু-সাহিদা আপু, উস্তায-উস্তাযাগণ এবং সহপাঠী বোনদের, শুভাকাঙ্ক্ষীদের এবং আমাদের নুরুল কুরআন একাডেমির। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই একাডেমির উস্তায-উস্তাযাগণ এবং সকল ছাত্র-ছাত্রী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে মাকবুল এবং মাবরুক করুন। আমীন।
————————————————- ————————————————- ————————————————- ———————————————
নুরুল কুরআন একাডেমিতে এই পর্যন্ত ৪ জন ছাত্রী হাফেজা হয়েছেন। তারা হলেন-
১. ফারজানা আমাতুল্লাহ
২. মুহসিনা আক্তার
৩. ইয়াসনা আরিফ
৪. ফাহমিদা জান্নাত তাসনিম
যারা হিফজ করা শুরু করেছেন বা করবেন বলে ভাবছেন তারা চাইলে আমাদের প্রিরেকর্ডেড কোর্স ‘হিফজ নির্দেশিকা কোর্স’টি করে নিতে পারেন। এর মাধ্যমে আপনি কীভাবে সঠিক পন্থায় হিফজের পথে অগ্রসর হবেন সেই বিষয়ে একটি পরিষ্কার গাইডলাইন পপাবেন ইনশাআল্লাহ। কোর্সটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে
আমাদের একাডেমিতেও দীর্ঘ মেয়াদে হিফয করতে পরেন। আমাদের ‘হিফজুল কুরআন কোর্স’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে
আপনি চাইলে শুধু ৩০ নং পারাও (আম্মা পারা) হিফজ করতে পারেন। এর জন্য রয়েছে আমাদের ‘৩০ নং পারা হিফজ কোর্স’। এই কোর্স’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে
যেসব মাধ্যমে আমাদেরকে ফলো করে একাডেমির কার্যক্রম সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট পেতে পারেন –
- ফেসবুক পেইজ- www.facebook.com/NLQURAN
- ফেসবুক গ্রুপ- https://web.facebook.com/groups/nlquran
- টেলিগ্রাম চ্যানেল- https://t.me/nlquran